বিজয় দিবস

বসে বসে ছোট বেলার স্মৃতিচারন করার চেষ্টা করছি। তখনও ১৬ই ডিসেম্বর আসতো। উৎসব হতো, আনন্দ হতো। এখনো হচ্ছে, তবে উৎসবের রং-ঢং সব বদলে গেছে।
তখনকার দিনগুলো ছিলো অন্যরকম। কুয়াশার আস্তরণ কাটিতে সূর্যরশ্মি বেরিয়ে আসতে কিছুটা বেলা হয়ে যেত। তার আগেই আমাদের ঘুম ভেঙে যেত। চারদিক থেকে ভেসে আসতো দরদভরা কতো দেশাত্মবোধক গান।
“সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি….”
কিংবা “সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা সোনা নয় তত খাঁটি…..”
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেতাম সেই গানের মাঝে। তখন গানের মূল অর্থ বিশেষ কিছু উপলব্ধি করতে পারতাম না জানি, তবুও বেশ ভালো লাগতো।
নতুন জামা পরে তৈরি হয়ে যেতাম। আম্মুর কাছে কিছু মার্কার পেন ছিলো। তার মধ্য হতে লাল আর সবুজ রঙের কলম দিয়ে আমাদের মোলায়েম দু’ গালে ছোট্ট করে দুটি পতাকা এঁকে দিত। বারংবার আয়নার সামনে গিয়ে তা দেখতাম। বেশ সুন্দর হতো কিন্তু।
এই দিনে সবচেয়ে বেশি ব্যাস্ত দেখতাম যাকে, তিনি হচ্ছেন আমার নানাভাই। ৬ নং সেক্টরের সাধারণ(?) একজন মুক্তিযোদ্ধা। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে পড়তেন সকাল সকাল। নাস্তাও করতেন না। হয়তো চিরুনি দিয়ে দাড়ি আঁচড়াচ্ছিলেন এমন সময় টেনে টেনে জিজ্ঞেস করলাম,
“কই যাও?”
“বাজারে।”
“কেন?”
জবাব না দিয়ে পাঞ্জাবি পরতেন। আবার জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু জবাব পেতাম না। যেন অনেক ব্যাস্ত তিঁনি। সেদিন সেই আলোরাঙা প্রভাতে তাঁর প্রবীণ আঁখিজোড়ায় স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম দেদীপ্যমান তারকারাজি। যেন—
“আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে নিদ্রাবিহীন গগনতলে।”
না জানি সেই দিনটা কেমন ছিলো। বিকেল ৪ টা ২১ মিনিটে কেমন অনূভুতি জেগেছিলো তাদের অন্তরে। খানিকটা আনন্দ, খানিকটা দুঃখ, মুখের কোনে একটুখানি মুচকি হাসি। ভোরের পদ্ম ফোটার মতো ধীরে ধীরে আনন্দ ছড়িয়ে পরে তাদের মাঝে। একটার পর একটা একটার পর একটা ফুটতে ফুটতে সমস্ত দেশ ফুটন্ত পদ্মে ভরে যায়। কূলকিনারা বিহীন আনন্দ সবার মাঝে। কেউ কেউ লুটিয়ে পরে আল্লাহর দরবারে, শুকরিয়া আদায় করে। একজন মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া কেউই এই দিনটার মর্ম উপলব্ধি করতে পারবে না। গত দীর্ঘ নয় মাসে কত গ্রাম পুড়েছে, কত শিশু মরেছে, কত মা-বোন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কত তরুন তাদের প্রান বিসর্জন দিয়েছে, কত শিশু মায়ের লাশের উপর কেঁদেছে, কত বাবা….. আরও কত কি!
যেই মানুষরা নিজের প্রান হাতে নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন তাদের কাছে এই দিনটা মহান। আমার অনেক ইচ্ছে জাগে জানতে, সেই দিনটা উপলব্ধি করতে।
সেই ১৯৭১।
সেই ১৬ই ডিসেম্বর।
সেই বিকেল।
সেই ৪ টা ২১ মিনিট।

এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। বিজয় দিবস এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভাগ হয়ে গেছে। মানুষের আনাগোনাও হ্রাস পেয়েছে অনেক।
তবুও আমাদের বিশ্বাস বিজয় দিবস সকলের মাঝে বেঁচে রবে চিরকাল।

1 মন্তব্য

মন্তব্য করুন