কোনো ধর্মধ্বজের প্রতি

107
0

প্রেমের ধর্ম করছ প্রচার কে গো তুমি সবুট লাথি নিয়ে,
ডায়ার-মার্কা শিষ্টাচারের লাল-পেয়ালার শেষ তলানি পিয়ে!
কুষলে তো চলছে তোমার অর্ধঘন্টা ধর্মোপদেশ দেওয়া,
টিফিন এবং টি-এর ফাঁকে? জমছে ভাল ঋষ্ট কথার খেয়া?
মুখোস খোলা, মুখস্থ বোল বোলো না আর টিয়াপাখির মত,
মোটা মাসহারার মোহে,- দোরেখা ঢং চালাবে আর কত?
বয়স গত, ক্ষ্যাপার মত কামড় দিতে এলে নকল দাঁতে?
বাঁধানো দাঁত উল্টে গিয়ে, আহা, শেষে লাগবে যে টাক রাতে!
নিরীহ যে সত্যাগ্রহী -কি লাভ হল তারে লাথি মেরে?
সে করেছে তোমায় ক্ষমা, তার চোখে আজ নাও দেখে খৃষ্টেরে।

অক্রোধে ক্রোধ জিনতে হবে, -সে শিক্ষা কি রইল শিকেয় তোলা,
ডিগ্রি নিয়ে ফুরিয়ে গেছে ডাগর-বুলির যা কিছু বোলাবোলা?
উদর তন্ত্র উদরতা? ধর্ম কেবল কথারই কাপ্তেনী?
ডঙ্কা-নাদের পিছন পিছন সত্য নিয়ে খেলছ ছেনিমেনি?
চেয়ে দেখ ক্রুসের পরে ক্ষুদ্ধ কে ওই তোমার ব্যবহারে।
জীবন্তবৎ পাষাণ-মুরৎ! -হেঁটমাথা তার লজ্জাতে ধিক্কারে।
কুড়ি শ বতসরের ক্ষত লাল হয়ে তাঁর উঠছত্র নতুন করে।
দেখছে জগৎ -পাথর ফেটে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে শোণিত ঝরে।
দাও ক্ষমা দাও, চোখ মেলে চাও,–
কি কান্ড হায় করছ গজাল ঠুকে?
নিরীহদের নির্যাতনের সব ব্যথা কার বাজছে দ্যাখো বুকে!
কিম্বা দ্যাখার নাই প্রয়োজন, তোমরা এখন সবাই বিজিগীষু,
জিঙ্গো আসল ইষ্ট সবার, তার আবরণ-দেবতা মাত্র যীশু!
ডায়ার-ডৌল জবরদস্তি, -তাতেই দেখি আজ তোমাদের রুচি।
গোবর-দস্ত আইন গড়ে নিষ্ঠুরতায় নিচ্ছ করে শুচি।

বীরত্বেরই বিজয়-মালা বর্বরতার দিচ্ছ গলায় তুলে।
অমানুষের করছ পূজা, সেরা-মানুষ কৃষ্টদেবে ভুল।
মরদ-মেয়ে ভুগছ সমান হূণ-বিজয়ের বড়াই-লালচ-রোগে,
মানুষকে আর মানুষ বলেই চিনতে যেন চাইছ না, হায়, চোখে।
ঢাকের পিছে ট্যামট্যামি-প্রায় টমির ধাঁচায় ট্যাঁশটোশও আজ ঘোরে।
শয়তানই যে হাওয়ায় হাঁটায় শূন্যে ওঠায় সে হুঁশ গেছে সরে।
নেইক খেয়াল, আত্মা বেচে জগত-জোড়া কিনছে জমিদারী।
কে জানে ক’দিনের ঠিকা, ঠিকাদারের ঠ্যাকার কিন্তু ভারি!
ধিঙ্গি চলে জঙ্গী চালে, কুচ, করে লাল কাগজ-ওলা চলে,
নাক তুলে যায় দালাল-ফোড়ে, আজ দেখি হায় পাদরীও সেই দলে!

যাও দলে যাও, ডঙ্কা বাজাও, অহঙ্কারের ছায়া ক্ষণস্থায়ী।
মিছাই ব্রতের বিঘ্ন ঘটাও অহঙ্কারের হুমকি-ব্যবসায়ী!
আমরা তোমার চাই না শিক্ষা, চাই না বিদ্যা, হে বিদ্যা-বিক্রয়ী!
ধর্ম-কথাও পণ্য যাদের তাদের পণ্য কিনতে ব্যাগ্র নাহি।
মানুষ খুঁজে ফিরছি মোরা, -মানুষ হবার রাস্তা যে বাতলাবে,
তিক্ত হয়ে গেছে জীবন ঘরের পরের অমানুষের তাঁবে।
ফলিয়ে দেবে মর্ত্যে যে জন বুদ্ধ-যীশুর স্বর্গ-সূচন বাণী,
শহীদ-কুলের হৃদ্য-শৌর্য হৃদয়ে যার পেতেছে রাজধানী,

জাতিভেদের টিটকারী যে পরকে শুধুই দেয় না নানান ছলে,
জমিয়ে বুকে জিঙ্গোয়ানীর জবর জাতিভেদের হলাহলে,
ষোল-আনা মানুষ হবার নিমন্ত্রণ দেবে যে সব জনে,
সেই মানুষে খুঁজছি মোরা, অহনিশি খুঁজছি ব্যাকুল মনে,
নিক্তি ধরে করলে তৌল ওহন সে যার ভজবে পুরাপুরি,
লোভের মোহের মন্ত্রণাতে ভাবের ঘরে করবে না যে চুরি,
পথ চেয়ে তার সই অনাচার দুঃখ অপার অন্তত লাঞ্চনা,
বেশ জানি, আজ সয় যারা ক্লেশ তাদের তরেই স্বর্গীয় সান্তনা,
নিরীহ যেই ধন্য যে সেই ধৃত-ব্রত দৈব-মাশাল-ধারী,
নিঃস্ব যারা তারাই হবে বিপুল ভবে রাজ্যে-অধিকারী।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
লিখেছেন

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ছড়াকার, অনুবাদক, এবং ছান্দসিক। তিনি রবীন্দ্রযুগের অন্যতম বিশিষ্ট কবি। তাঁর কবিতায় ছন্দের কারুকাজ, শব্দ ও ভাষা যথোপযুক্ত ব্যবহারের কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ছন্দের যাদুকর নামে আখ্যায়িত করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নিমতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রজনীনাথ দত্ত ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন একজন গৃহবধূ। সত্যেন্দ্রনাথের পৈতৃক নিবাস বর্ধমানের চুপী গ্রামে।

সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৯৯) এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে এফএ (১৯০১) পাস করেন; কিন্তু পরে বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তিনি প্রথমে পিতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন এবং পরে ব্যবসা ছেড়ে কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সবিতা" ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল "সন্ধিক্ষণ" (১৯০৫), "বেণু ও বীণা" (১৯০৬), "হোমশিখা" (১৯০৭), "ফুলের ফসল" (১৯১১), "কুহু ও কেকা" (১৯১২), "তুলির লিখন" (১৯১৪), "মনিমঞ্জুষা" (১৯১৫), "পুণ্যস্নান" (১৯১৯), এবং "সোনার তরী" (১৯২১)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় নানাবিধ ছন্দোনির্মাণ ও ছন্দ উদ্ভাবনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বাংলা ভাষার নিজস্ব বাগধারা ও ধ্বনি সহযোগে নতুন ছন্দসৃষ্টি তাঁর কবিপ্রতিভার মৌলিক কীর্তি। এজন্য তিনি "ছন্দের জাদুকর" ও "ছন্দোরাজ" নামে সাধারণ্যে পরিচিত।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি মেথরদের মতো অস্পৃশ্য ও অবহেলিত সাধারণ মানুষ নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিদেশি কবিতার সফল অনুবাদকও ছিলেন। তিনি আরবি, ফারসি, চীনা, জাপানি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যএর বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ঘটান।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯২২ সালের ২৫ জুন কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি।

মন্তব্য করুন