মানুষের মানচিত্র ১৩

কলার ভেলায় লাশ, সাথে ভেসে চলে এক স্বপ্নবান বধু।
হাঙর কুমির আসে, আছে ঝড়, অন্ধকার দরিয়ার বান,
লাশের শরীর থেকে মাংশ খসে, বেহুলার অসীম পরান,
কিছুতে টলে না স্বপ্ন, আকাংখার শক্ত হাত মেলে রাখে বঁধু …

ওলো ও বেদেনি শোন, ছোবল দিয়েছে বুকে জাত কালসাপ,
নীলবর্ন হয়ে আসে সোনার গতরখানা অঙ্গ জ্বলে বিষে,
কী সাপে দংশিলো লখা? ঘোরবর্ন সাপ ছিলো অন্ধকারে মিশে।
উদোম নাচন দিয়ে দুই কানে শোনা তুই মন্ত্রের আলাপ।

কী সাপে দংশিলো লখা! জীবন আন্ধার হলো, অঙ্গ হলো কালি,
এ-কোন সাপের বিষ জীবন নেয় না শুধু শরীর জ্বালায়,
পরান পোড়ায় নামে বিষের নহর যেন রক্তের নালায়-
দোহাই বেদেনি তোর, বিষের বাগানে তুই বিষহরা মালি

মন্ত্র দে,মন্ত্র দে তুই, ছোবলের ক্ষতে রাখ বিষমাখা ঠোঁট ।
বিষে নীল লখিন্দর ভাসে দ্যাখ পৃথিবীর কীর্তনখোলায়,
জলের উপরে ভাসে বিষাহত আকাংখারা, জলের ঘোলায়-
কী সাপে দংশিলো লখা, জীবনের নাড়ি কাটে বিষের কমোট?

ওড়ে আকাশে শকুন। উত্তর দিগন্ত ঘিরে কালো মেঘ আসে।
কেউ কি বেহুলা নেই স্বপ্নবান কোন এক তরুন বেদেনি?
স্বজন-রক্তের কাছে, স্বজন-হাড়ের কাছে দায়বদ্ধ, ঋনী?
কেউ কি বেহুলা নেই হাড়ের খোয়াব নিয়ে বৈরী জলে ভাসে??

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
WRITTEN BY

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন