ময়না তদন্ত

আত্মপ্রকাশের সামনে দাঁড়িয়েছিলে তুমি।
তুমি—মানে সামাজিক নারী,
মানে সংসার, সন্তান, বাড়িভাড়া, মরিচ, পেঁয়াজ,
মানে দশটা-পাঁচটা, বিকেলে ক্রিসেন্ট লেক
নয়তো বেইলি রোডে নাগরিক নটনটি,
শুধু অভিনয়,
শুধু কথার মুখোশ, চমৎকার, বনেদি মসৃন।

তুমি—মানে সুস্থতার নামে এক জটিল জীবন,
শাড়ি, টিভি, ভিসিআর,
দু’চারটে গোপন চুম্বনে গাঁথা পুরোনো প্রেমের স্মৃতি,
মানে সুঘ্রান, মোহময় সেক্সএ্যাপিল,
মানে সুস্থতা, মূলত যা শোষন,
মানে বেঁচেবর্তে আছি,
এই তো, ভালোই……

তুমি—মানে প্রতারনা, শোকেসে সাজিয়ে রাখা কার্লমার্কস, লেনিন,
মানে সভামঞ্চে শ্রমিক শ্রেনীর পক্ষে তেজী শব্দাবলী,
মানে চার ইঞ্চি ফোমে গা ডুবিয়ে
নগ্ন স্তনে হাত, চোখে স্বপ্ন—
ব্যালকনিসহ বাড়ি,
ব্যক্তিগত দ্রুতযানে স্মৃতিসৌধ দেখে আসা।

আত্মপ্রকাশের পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলে তুমি,
তুমি—মানে কারাগার, বন্ধনের সোনালি শিকল,
মানে মধ্যরাতে টলোমলো পৃথিবীর ঘরে ফেরা নয়
সুগন্ধি মাতাল মাংশে ডুবে যাওয়া উষ্ণ বিছানা।

তুমি—মানে ঝলোমলো, হিরক-ব্যর্থতা,
মানে ছিন্নমূল দুপুরের ফুটপাতে ডালরুটি নয়
আলস্যের মেদ মেখে বেড়ে ওঠা শোভন জীবন,
ঘুম, কালোটাকা,
মানে ককটেল পার্টি,
মানে বন্ধুর পত্নির কাঁধে হাত, আবডালে ছোঁয়াছুঁয়ি,
মানে কন্যার স্বামীর সাথে মা উধাও
ব্লু-ব্লু—
তবু, রমনীরা সতিসাধ্বি, পত্নিপরায়ন স্বামী।

সুস্থতার ভূমিকায় ভাঁড়েরা মানিয়ে যায় অবিকল,
কেবল বাড়তে থাকে রক্তচাপ, মূত্রে চিনি আর
নিদ্রাহীন রাত্রির প্রহর—

কোথাও সুস্থতা নেই।
এ সময়ে শোষনের সুশোভন নামই সুস্থতা—
তুমি সেই সুস্থতার নির্বোধ প্রতীক।
আত্মপ্রকাশের সামনে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন