সাহিত্য রস

সবচেয়ে বড় কবিতা, গল্প, ছন্দ এবং গান প্রকাশের ওয়েবসাইট

সূর্য্য ও মৈনাক-গিরি

1
0

উদয়-অচলে,
দিবা-মুখে এক-চক্রে দিলা দরশন,
অংশু-মালা গলে,
বিতরি সুবর্ণ-রশ্মি চৌদিকে তপন।
ফুটিল কমল-জলে
সূর্য্যমুখী সুখে স্থলে,
কোকিল গাইল কলে,
আমোদি কানন।
জাগে বিশ্বে নিদ্রা ত্যজি বিশ্ববাসী জন;
পুনঃ যেন দেব স্রষ্টা সৃজিলা মহীরে;
সজীব হইলা সবে জনমি, অচিরে।
অবহেলি উদয়-অচলে,
শূন্য-পথে রথবর চলে;
বাড়িতে লাগিল বেলা,
পদ্মের বাড়িল খেলা,
রজনী তারার মেলা সর্ব্বত্র ভাঙ্গিল;—
কর-জালে দশ দিক্ হাসি উজলিল।
উঠিতে লাগিলা ভানু নীল নভঃস্থলে;
দ্বিতীয়-তপন-রূপে নীল সিন্ধু-জলে
মৈনাক ভাসিল।
কহিল গম্ভীরে শৈল দেব দিবাকরে;—
“দেখি তব ধীর গতি দুখে আঁখি ঝরে;
পাও যদি কষ্ট,—এস, পৃষ্ঠাসন দিব;
যেখানে উঠিতে চাও, সবলে তুলিব।”
কহিলা হাসিয়া ভানু;—“তুমি শিষ্টমতি;
দৈববলে বলী অামি, দৈববলে গতি।”

মধ্যাকাশে শোভিল তপন,—
উজ্জ্বল-যৌবন, প্রচণ্ড-কিরণ;
তাপিল উত্তাপে মহী; পবন বহিলা
অাগুনের শ্বাস-রূপে; সব শুকাইলা—
শুকাল কাননে ফুল;
প্রাণিকুল ভয়াকুল;
জলের শীতল দেহ দহিয়া উঠিল;
কমলিনী কেবল হাসিল!
হেন কালে পতনের দশা,
আ মরি; সহসা
আসি উতরিল;—
হিরণ্ময় রাজাসন ত্যজিতে হইল!
অধোগামী এবে রবি,
বিষাদে মলিন-ছবি,
হেরি মৈনাকেরে পুনঃ নীল সিন্ধু-জলে,
সম্ভাষি কহিলা কুতূহলে;—
“পাইতেছি কষ্ট, ভাই, পূর্ব্বাসন লাগি;
দেহ পৃষ্ঠাসন এবে, এই বর মাগি;
লও ফিরে মোরে, সখে, ও মধ্য-গগনে;—
অাবার রাজত্ব করি, এই ইচ্ছা মনে।”
হাসি উত্তরিল শৈল;—“হে মূঢ় তপন,
অধঃপাতে গতি যার কে তার রক্ষণ!
রমার থাকিলে কৃপা, সবে ভালবাসে;—
কাঁদ যদি, সঙ্গে কাঁদে; হাস যদি, হাসে;
ঢাকেন বদন যবে মাধব-রমণী,
সকলে পলায় রড়ে, দেখি যেন ফণী।”

মাইকেল মধুসূদন দত্ত
WRITTEN BY

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি এবং নাট্যকার ও প্রহসন রচয়িতা। তাকে বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণ্য করা হয়। ঐতিহ্যের অনুবর্তিতা অমান্য করে নব্যরীতি প্রবর্তনের কারণে তাকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে। তার পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন একজন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন একজন সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক মহিলা।

মধুসূদন দত্তের শিক্ষাজীবন শুরু হয় সাগরদাঁড়ি পাঠশালায়। পরে তিনি কলকাতার খিদিরপুর স্কুল এবং হিন্দু কলেজে পড়াশোনা করেন। হিন্দু কলেজে পড়াকালীন তিনি ইংরেজি সাহিত্যে আগ্রহী হন এবং ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন।

১৮৪৩ সালে মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং মাইকেল নাম গ্রহণ করেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হন এবং বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য রীতিনীতির প্রবর্তন করেন।

মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে:

* **কবিতা:** "সনেট", "মধুসূদন চরিত", "বীরাঙ্গনা", "চতুর্দশপদী কবিতা"
* **নাটক:** "শর্মিষ্ঠা", "কালিদাস", "মেঘনাদবধ কাব্য", "কৃষ্ণকুমারী", "রুদ্রমহিষ"
* **প্রহসন:** "বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ", "পদ্মাবতী"

মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি বাংলা সাহিত্যে সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, এবং নাট্যকারের ভূমিকা প্রবর্তন করেন। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।

মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকর্মের কিছু উল্লেখযোগ্য অবদান নিম্নরূপ:

* তিনি বাংলা সাহিত্যে সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, এবং নাট্যকারের ভূমিকা প্রবর্তন করেন।
* তিনি বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতাবাদের প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
* তিনি বাংলা সাহিত্যে নারীবাদের ধারণা প্রবর্তন করেন।

মধুসূদন দত্ত একজন প্রতিভাবান কবি, নাট্যকার, এবং প্রহসন রচয়িতা ছিলেন। তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

মন্তব্য করুন