নির্বাসন

44
0

আমি ও নিখিলেশ, অর্থাৎ নিখিলেশ ও আমি, অর্থাৎ আমরা চারজন
একসঙ্গে সন্ধেবেলা কার্জন
পার্কের মধ্য দিয়ে,- চতুর্দিকে রাজকুমারীর মত আলো-
হেঁটে যাই, ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ঘড়ি ভয় দেখালো
উল্টো দিকে কাঁটা ঘুরে, আমাদের ঘাড় হেট
করা মূর্তি, আমরা চারজন হেটে যাই, মুখে সিগারেট
বদল হয়, আমরা কথা বলি না, রেড রোডের দু’পাশের
রঙিন ফুলবাগান থেকে নানা রঙের হাওয়া আসে, তাসের
ম্যাজিকের মতো গাড়িগুলো আসে ও যায়, আমরা এক ভাঙা কারখানায়
শিকল কিনতে গিয়েছিলাম, ফিরে যাচ্ছি, আমি বাকি তিনজনকে
চেয়ে দেখলুম, ওরাও আমাকে আড়চোখে…..
ছোট-বড়ো আলোয় বড়ো ছোট ছায়া সমান দুরত্বে
আমাদের, চাঁদ ও জ্যোৎস্নার মাঠে ইঁদুর বা কেঁচোর গর্তে
পা মচকে আমি পিছিয়ে পড়ি, ওরা দেখে না, এগিয়ে যায়
কখনো ওরা আলোয়, কখনো গাছের নিচে ছায়ায়
ওরা পিছনে ফেরে না, থামে না, ওরা যায়-
আমি নাস্তিকের গলায় নিজের ছায়াকে ডাকি, একশো মেয়ের চিৎকার
মেমোরিয়ালের পাশ থেকে হাসি-সমেত তিনবার
জেগে উঠে আড়াল করে, এবার আমি নিজের নাম
চেচাঁই খুব জোরে, কেউ সাড়া দেবার আগেই একটা নিলাম-
ওয়ালা ‘কানাকড়ি’, ‘কানাকড়ি’ হাতুড়ি ঠোকে, একটা ঢিল
তুলে ছুঁড়তে যেতেই কে যেন বললো, ‘সুনীল,
এখানে কী করছিস? আমি হাঁটু ও কপালের
রক্ত ঘাসে মুছে তৎক্ষণাৎ অন্ধকার সুবজ ও লালের
শিহরণ দেখি, দু’হাত উপরে তুলে বিচারক সপ্তর্ষিমন্ডল
আড়াল করতে ইচ্ছে হয়, ‘ওঠ্‌ বাড়ি চল্‌, কিংবা বল্‌
কোথায় লুকিয়েছিস নীরাকে? গলার স্বর শুনে মানুষকে
চেনা যায় না, একটি অন্ধ মেয়ে আমাকে বলেছিল, দু’চোখ উস্কে
আমি লোকটাকে তদন্ত করি; পাপ নেই, দুঃখ নেই এমন
পায়ে চলা পথ ধরে কারা আসে। যেন গহন বন
পেরিয়ে শিকারী এলো, জীবনের তীব্রতম প্রশ্ন মুখে তুলে
দাঁড়িয়ে রইলো, যেন ছুঁয়ে দিল বেদান্তের মন্দিরচূড়ার মতো আঙুলে
নীলিমার মতো নিঃস্বতা,- যেন কত চেনা, অথচ মুখ চিনি না, চোখ
চিনি না, ছায়া নেই, লোকটার এমন নির্মম, এক-জীবনের শোক
বুকে এলো, ‘কোথায় লুকিয়েছিস?’ ‘জানি না’ এ-কথা
কপালে রক্তের মতো, তবু বোঝে না রক্তের ভাষা, তৃষ্ণা ও ব্যর্থতা
বার বার প্রশ্ন করে, জানি না কোথঅয় লুকিয়েছি নীরাকে, অথবা নীরা কোথায়
লুকিয়ে রেখেছে আমা! কোথায় হারালো নিখিলেশ, বিদ্যমানতায়
পরস্পর ছায়া ও মূর্তি, ‘…. আবার একা হাঁটতে লাগলুম, বহুক্ষণ
কেউ এলো না সঙ্গে, না প্রশ্ন, না ছায়া, না নিখিলেশ, না ভালোবাসা
শুধু নির্বাসন।।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
লিখেছেন

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, এবং সাংবাদিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলায়। তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পড়াশোনা কলকাতায়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় কবিতার মাধ্যমে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "স্মৃতিস্তম্ভ" প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল:

* "অর্জুন" (১৯৫৪)
* "প্রথম আলো" (১৯৫৬)
* "সেই সময়" (১৯৬৩)
* "পূর্ব-পশ্চিম" (১৯৭১)
* "আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি" (১৯৭৭)
* "ভানু ও রাণু" (১৯৮২)
* "অন্ধকারের আলো" (১৯৯৭)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাগুলি আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁর কবিতাগুলি সাধারণ মানুষের জীবন, প্রেম, ভালোবাসা, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, ও সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায়। তাঁর কবিতার ভাষা ছিল সরল ও সহজবোধ্য।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন সফল ঔপন্যাসিকও ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল:

* "হঠাৎ নীরার জন্য" (১৯৬৩)
* "শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা" (১৯৬৬)
* "অর্ধেক জীবন" (১৯৭৩)
* "অরণ্যের দিনরাত্রি" (১৯৭৬)
* "কাকাবাবু" (১৯৮১)
* "মনের মানুষ" (১৯৮৬)
* "আয়নায় মুখ" (১৯৯০)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছোটগল্পকার হিসেবেও সফল ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পগুলির সংকলনগুলি হল:

* "এখনও দুপুর" (১৯৬৮)
* "আমার ছেলেবেলা" (১৯৭২)
* "রূপসী বাংলা" (১৯৭৫)
* "আমার সময়" (১৯৮০)
* "ছোটগল্পসমগ্র" (১৯৯৩)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন সমস্যার প্রতি আলোকপাত করেছেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সমর্থক ছিলেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার পথকে মসৃণ করেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, এবং সাংবাদিক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

* সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮)
* পদ্মভূষণ (১৯৯১)
* বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ (১৯৯৬)
* রবীন্দ্র পুরস্কার (২০০২)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্য করুন