কবির মৃত্যু : লোরকা স্মরণে

43
0

দু’জন খসখসে সবুজ উর্দিপরা সিপাহী
কবিকে নিয়ে গেল টানতে টানতে
কবি প্রশ্ন করলেন : আমার হাতে শিকল বেঁধেছ কেন?
সিপাহী দু’জন উত্তর দিল না;
সিপাহী দু’জনেরই জিভ কাটা।
অস্পষ্ট গোধুলি আলোয় তাদের পায়ে ভারী বুটের শব্দ
তাদের মুখে কঠোর বিষণ্নতা
তাদের চোখে বিজ্ঞাপনের আলোর লাল আভা।
মেটে রঙের রাস্তা চলে গেছে পুকুরের পাড় দিয়ে
ফ্লোরেসেন্ট বাঁশঝাড় ঘুরে-
ফসল কাটা মাঠে এখন
সদ্যকৃত বধ্যভূমি।
সেখানে আরও চারজন সিপাহী রাইফেল হাতে প্রস্তুত
তাদের ঘিরে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ
কেউ এসেছে বহু দূরের অড়হর ক্ষেত থেকে পায়ে হেঁটে
কেউ এসেছে পাটকলে ছুটির বাঁশি আগে বাজিয়ে
কেউ এসেছে ঘড়ির দোকানে ঝাঁপ ফেলে
কেউ এসেছে ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরে
কেউ এসেছে অন্ধের লাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে
জননী শিশুকে বাড়িতে রেখে আসেননি
যুবক এনেছে তার যুবতীকে
বৃদ্ধ ধরে আছে বৃদ্ধতরের কাঁধ
সবাই এসেছে একজন কবির
হত্যাদৃশ্য
প্রত্যক্ষ করতে।

খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো কবিকে,
তিনি দেখতে লাগলেন
তাঁর ডান হাতের আঙুলগুলো-
কনিষ্ঠায় একটি তিল, অনামিকা অলঙ্কারহীন
মধ্যমায় ঈষৎ টনটনে ব্যথা, তর্জনী সঙ্কেতময়
বৃদ্ধাঙ্গুলি বীভৎস, বিকৃত-
কবি সামান্য হাসলেন,
একজন সিপাহীকে বললেন, আঙুলে
রক্ত জমে যাচ্ছে হে,
হাতের শিকল খুলে দাও!
সহস্র জনতার চিৎকারে সিপাহীর কান
সেই মুহূর্তে বধির হয়ে গেল।

জনতার মধ্য থেকে একজন বৈজ্ঞানিক বললেন একজন কসাইকে,
পৃথিবীতে মানুষ যত বাড়ছে, ততই মুর্গী কমে যাচ্ছে।
একজন আদার ব্যাপারী জাহাজ মার্কা বিড়ি ধরিয়ে বললেন,
কাঁচা লঙ্কাতেও আজকাল তেমন ঝাল নেই!
একজন সংশয়বাদী উচ্চারণ করলেন আপন মনে,
বাপের জন্মেও এক সঙ্গে এত বেজম্মা দেখিনি, শালা!
পরাজিত এম এল এ বললেন একজন ব্যায়ামবীরকে,
কুঁচকিতে বড় আমবাত হচ্ছে হে আজকাল!
একজন ভিখিরি খুচরো পয়সা ভাঙিয়ে দেয় বাদামওয়ালাকে
একজন পকেটমারের হাত আকস্মাৎ অবশ হয়ে যায়
একজন ঘাটোয়াল বন্যার চিন্তায় আকুল হয়ে পড়ে
একজন প্রধানা শিক্ষয়িত্রী তাঁর ছাত্রীদের জানালেন
প্লেটো বলেছিলেন…
একজন ছাত্র একটি লম্বা লোককে বললো,
মাথাটা পকেটে পুরুন দাদা!
এক নারী অপর নারীকে বললো,
এখানে একটা গ্যালারি বানিয়ে দিলে পারতো…
একজন চাষী একজন জনমজুরকে পরামর্শ দেয়,
বৌটার মুখে ফোলিডল ঢেলে দিতে পারো না?
একজন মানুষ আর একজন মানুষকে বলে,
রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হবে না।
তবু একজন সম্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, এ তো ভুল লোককে
এনেছে। ভুল মানুষ, ভুল মানুষ।

রক্ত গোধূলির পশ্চিমে জ্যোৎস্না, দক্ষিণে মেঘ
বাঁশবনে ডেকে উঠলো বিপন্ন শেয়াল
নারীর অভিমানের মতন পাতলা ছায়া ভাসে
পুকুরের জলে
ঝুমঝুমির মতন একটা বকুল গাছে কয়েকশো পাখির ডাক
কবি তাঁর হাতের আঙুল থেকে চোখ তুলে তাকালেন,
জনতার কেন্দ্রবিন্দুতে
রেখা ও অক্ষর থেকে রক্তমাংসের সমাহার
তাঁকে নিয়ে গেল অরণ্যের দিকে
ছেলেবেলার বাতাবি লেবু গাছের সঙ্গে মিশে গেল
হেমন্ত দিনের শেষ আলো
তিনি দেখলেন সেতুর নিচে ঘনায়মান অন্ধকারে
একগুচ্ছ জোনাকি
দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হলো চুল, তিনি বুঝতে পারলেন
সমুদ্র থেকে আসছে বৃষ্টিময় মেঘ
তিনি বৃষ্টির জন্য চোখ তুলে আবার
দেখতে পেলেন অরণ্য
অরণের প্রতিটি বৃক্ষের স্বাধীনতা-
গাব গাছ বেয়ে মন্থরভাবে নেমে এলো একটি তক্ষক
ঠিক ঘড়ির মতন সে সাত বার ডাকলো :
সঙ্গে সঙ্গে ছয় রিপুর মতন ছ’জন
বোবা কালা সিপাহী
উঁচিয়ে ধরলো রাইফেল-
যেন মাঝখানে রয়েছে একজন ছেলেধরা
এমন ভাবে জনতা ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো
ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
কবির স্বতঃপ্রবৃত্ত ঠোঁট নড়ে উঠলো
তিনি অস্ফুট হৃষ্টতায় বললেন :
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
মানুষের মুক্তি আসুক!
আমার শিকল খুলে দাও!
কবি অত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি মানুষ
নারীদের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি নারী
তিনি দু’জনকেই পেয়ে গেলেন
কবি আবার তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললেন,
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব!

প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-
যেমন যায়,
কবি নিঃশব্দে হাসলেন
দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল
কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে
তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ
কবি শান্ত ভাবে বললেন,
আমি মরবো না!
মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না।
চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল
পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি
ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে
জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-
কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না
কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্‌কে পড়া মাত্রই
আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে
শেষে নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার
নড়ে উঠলো কি উঠলো না
কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি।

আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
লিখেছেন

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, এবং সাংবাদিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলায়। তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পড়াশোনা কলকাতায়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় কবিতার মাধ্যমে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "স্মৃতিস্তম্ভ" প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল:

* "অর্জুন" (১৯৫৪)
* "প্রথম আলো" (১৯৫৬)
* "সেই সময়" (১৯৬৩)
* "পূর্ব-পশ্চিম" (১৯৭১)
* "আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি" (১৯৭৭)
* "ভানু ও রাণু" (১৯৮২)
* "অন্ধকারের আলো" (১৯৯৭)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাগুলি আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁর কবিতাগুলি সাধারণ মানুষের জীবন, প্রেম, ভালোবাসা, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, ও সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায়। তাঁর কবিতার ভাষা ছিল সরল ও সহজবোধ্য।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন সফল ঔপন্যাসিকও ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল:

* "হঠাৎ নীরার জন্য" (১৯৬৩)
* "শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা" (১৯৬৬)
* "অর্ধেক জীবন" (১৯৭৩)
* "অরণ্যের দিনরাত্রি" (১৯৭৬)
* "কাকাবাবু" (১৯৮১)
* "মনের মানুষ" (১৯৮৬)
* "আয়নায় মুখ" (১৯৯০)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছোটগল্পকার হিসেবেও সফল ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পগুলির সংকলনগুলি হল:

* "এখনও দুপুর" (১৯৬৮)
* "আমার ছেলেবেলা" (১৯৭২)
* "রূপসী বাংলা" (১৯৭৫)
* "আমার সময়" (১৯৮০)
* "ছোটগল্পসমগ্র" (১৯৯৩)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন সমস্যার প্রতি আলোকপাত করেছেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সমর্থক ছিলেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার পথকে মসৃণ করেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, এবং সাংবাদিক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

* সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮)
* পদ্মভূষণ (১৯৯১)
* বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ (১৯৯৬)
* রবীন্দ্র পুরস্কার (২০০২)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্য করুন