চরকার গান

64
0

ভোমরায় গান গায় চরকায়, শোন ভাই!
খেই নাও, পাঁজা দাও, আমরাও গান গাই।
ঘর-বার করবার দরকার নেই আর,
মন দাও চরকায় আপনার আপনার!
চরকার ঘর্ঘর পড়শীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর ক্ষীর-সর, -আপনায় নির্ভর!
পড়শীর কন্ঠে জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া।

ঝর কায় ঝুর ঝুর ফুর ফুর বইছে!
চরকার বুলবুল কোন বোল কইছে?
কোন ধন দরকার চরকার আজ গো?
ঝিউড়ির খেই আর বউড়ির পাঁজ গো!
চরকার ঘর্ঘর পল্লীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর ঘির দীপ, -আপনায় নির্ভর!
পল্লীর উল্লাস জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!

আর নয় আইটাই ঢিস-ঢিস দিন-ভর,
শোন বিশকর্মার বিস্ময়-মন্তর!
চরকার চর্যায় সন্তোষ মনটায়,
রোজগার রোজদিন ঘন্টায় ঘন্টায়!
চরকার ঘর্ঘর বস্তির ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর মঙ্গল, -আপনায় নির্ভর!
বন্দর-পত্তন হঞ্জে সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!

চরকায় সম্পদ, চরকায় অন্ন,
বাংলার চরকায় ঝলকায় স্বর্ণ!
বাংলার মসলিন বোগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন-তৌলেই কিনতেন একদিন।
চরকার ঘর্ঘর শ্রেষ্ঠীর ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর সম্পদ, -আপনায় নির্ভর!
সুপ্তের রাজ্যে দৈবের সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!

চরকাই লজ্জার সজ্জার বস্ত্র।
চরকাই দৈনের সংসার-অস্ত্র।
চরকাই সন্তান চরকাই সম্মান।
চরকায় দুঃখীর দুঃখের শেষ ত্রাণ।
চরকার ঘর্ঘর বঙ্গের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর সমভ্রম, -আপনায় নির্ভর!
প্রত্যাশ ছাড়বার জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!

ফুরসুৎ সার্থক করবার ভেলকি!
উসখুস হাত! বিশকর্মার খেল কি!
তন্দ্রার হুদ্দোয় একলার দোকলা!
চরকাই একজাই পায়সার টোকলা।
চরকার ঘর্ঘর হিন্দের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর হিকমৎ, -আপনায় নির্ভর!
লাখ লাখ চিত্তে জাগল সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!

নিঃস্বের মূলধন রিক্তের সঞ্চয়,
বঙ্গের স্বস্তিক চরকার গাও জয়!
চরকায় দৌলত! চরকায় ইজ্জৎ!
চরকায় উজ্জ্বল লক্ষীর ইজ্জৎ!
চরকার ঘর্ঘর গৌড়ের ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর গৌরব, -আপনায় নির্ভর!
গঙ্গায় মেঘনায় তিস্তায় সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া!

চন্দ্রের চরকায় জ্যোৎস্নার সৃষ্টি!
সূর্যের কাটনায় কাঞ্চন বৃষ্টি!
ইন্দ্রের চরকায় মেঘ জল থান থান।
হিন্দের চরকায় ইজ্জৎ সম্মান!
চরকার দৌলত! ইজ্জৎ ঘর-ঘর।
ঘর-ঘর হিম্মৎ, -আপনায় নির্ভর!
গুজরাট-পাঞ্জাব-বাংলায় সাড়া,
দাঁড়া আপনার পায়ে দাঁড়া

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
লিখেছেন

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ছড়াকার, অনুবাদক, এবং ছান্দসিক। তিনি রবীন্দ্রযুগের অন্যতম বিশিষ্ট কবি। তাঁর কবিতায় ছন্দের কারুকাজ, শব্দ ও ভাষা যথোপযুক্ত ব্যবহারের কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ছন্দের যাদুকর নামে আখ্যায়িত করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নিমতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রজনীনাথ দত্ত ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন একজন গৃহবধূ। সত্যেন্দ্রনাথের পৈতৃক নিবাস বর্ধমানের চুপী গ্রামে।

সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৯৯) এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে এফএ (১৯০১) পাস করেন; কিন্তু পরে বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তিনি প্রথমে পিতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন এবং পরে ব্যবসা ছেড়ে কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সবিতা" ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল "সন্ধিক্ষণ" (১৯০৫), "বেণু ও বীণা" (১৯০৬), "হোমশিখা" (১৯০৭), "ফুলের ফসল" (১৯১১), "কুহু ও কেকা" (১৯১২), "তুলির লিখন" (১৯১৪), "মনিমঞ্জুষা" (১৯১৫), "পুণ্যস্নান" (১৯১৯), এবং "সোনার তরী" (১৯২১)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় নানাবিধ ছন্দোনির্মাণ ও ছন্দ উদ্ভাবনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বাংলা ভাষার নিজস্ব বাগধারা ও ধ্বনি সহযোগে নতুন ছন্দসৃষ্টি তাঁর কবিপ্রতিভার মৌলিক কীর্তি। এজন্য তিনি "ছন্দের জাদুকর" ও "ছন্দোরাজ" নামে সাধারণ্যে পরিচিত।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি মেথরদের মতো অস্পৃশ্য ও অবহেলিত সাধারণ মানুষ নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিদেশি কবিতার সফল অনুবাদকও ছিলেন। তিনি আরবি, ফারসি, চীনা, জাপানি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যএর বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ঘটান।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯২২ সালের ২৫ জুন কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি।

মন্তব্য করুন