মিছিল

যে যাবে না সে থাকুক, চলো, আমরা এগিয়ে যাই।
যে-সত্য জেনেছি পুড়ে, রক্ত দিয়ে যে-মন্ত্র শিখেছি,
আজ সেই মন্ত্রের সপক্ষে নেবো দীপ্র হাতিয়ার।
শ্লোগানে কাঁপুক বিশ্ব, চলো আমরা এগিয়ে যাই।

প্রথমে পোড়াই চলো অন্তর্গত ভীরুতার পাপ,
বাড়তি মেদের মতো বিশ্বাসের দ্বিধা ও জড়তা।
সহস্র বর্ষের গ্লানি, পরাধীন স্নায়ুতন্ত্রীগুলো,
যুক্তির আঘাতে চলো মুক্ত করি চেতনার জট।

আমরা এগিয়ে যাবো শ্রেনীহীন পৃথিবীর দিকে,
আমাদের সাথে যাবে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস,
অনার্যের উষ্ণ লহু, সংঘশক্তি, শিল্পে সুনিপুন
কর্মঠ, উদ্যমশীল, বীর্যবান শ্যামল শরীর।

আমাদের সাথে যাবে ক্ষেত্রভূমি, খিলক্ষেত্র, নদী,
কৃষিসভ্যতার স্মৃতি, সুপ্রাচীন মহান গৌরব।
কার্পাশের দুকূল, পত্রোর্ন আর মিহি মসলিন,
আমাদের সাথে যাবে তন্তু-দক্ষ শিল্পীর আঙুল।

দ্বিধাহীন ঋজু মাথা, চলো, আমরা এগিয়ে যাই,
সামন্ত জঞ্জালগুলো ঝেড়ে ফেলি বলিষ্ঠ আঘাতে।
সম্পর্কের বনেদি পোশাক আর বাতিল নিয়ম
ঝেড়ে ফেলি এসো আজ বৈষম্যের সকল ধারনা।

লক্ষ্যস্থির আমাদের, চলো, সামনে এগিয়ে যাই।
আমাদের সাথে যাবে তিতুমীর, সিপাহী বিপ্লব,
আমাদের সাথে যাবে অস্ত্রাগার দখলের হাত,
কাল বোশেখির মতো রক্তবীজ, বিপুল উত্থান।

উত্তাল বাংলার রোষে ছিন্নভিন্ন বেনিয়া বৃটিশ,
বিলুপ্ত নীলের চাষ, পীড়নের দুইশো বছর।
শোষক বদলে যায়, টিকে থাকে শোষনের ফাঁদ,
মসনদে নব প্রভু জন্ম নেয় নতুন শোষক।

চলো, আমরা এগিয়ে যাই, আমাদের সাথে যাবে
বায়ান্নর শহীদ মিনার, যাবে গণ অভ্যুত্থান,
একাত্তুর অস্ত্র হাতে সুনিপুন গেরিলার মতো।
আমাদের সাথে যাবে ত্রিশ লক্ষ রক্তাক্ত হৃদয়।

শোষক বদলে যায়, টিকে থাকে শোষনের ফাঁদ,
টিকে থাকে শ্রেণিভেদ, ঘুনে ধরা জীর্ন সমাজ কাঠামো।
পতাকা বদলে যায়, বদলায় মানচিত্র-সীমা,
টিকে থাকে গৃহহীন, বস্ত্রহীন ক্ষুধার্ত জীবন।

আমরা এগিয়ে যাই শ্রেণিহীন পৃথিবীর দিকে,
চলো যে-হাত শ্রমের হাত, যে-হাত শিল্পের হাত,
যে-হাত সেবার হাত, সে-হাত সশস্ত্র করি, চলো,
আমরা সশস্ত্র হোই সমতার পবিত্র বিশ্বাসে।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন