প্রথম লেখা।

68
1

গির্জার ঘন্টা টা টং টং করে বেজে উঠল। বসন্তের এক সকাল বেলা। খুবই মুগ্ধকর পরিবেশ। যিশুর সামনে প্রার্থনা রত অবস্থায় এক ৬০ উর্ধ বয়সি বৃদ্ধ। মাথা ভর্তি তাহার পাকা চুল মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। তবে মাঝে মাঝে এক দুইটা কালোও রয়েছে৷ চোখে চশমা, যেটা দেখে আন্দাজ করা যায় চোখে খুবই কম দেখেন তিনি। খুবই করুন ভঙ্গিতে যিশুর কাছে প্রার্থনা করছেন তিনি। দেখে যেকেউ মনে করবেন জিবনের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি হয়তো নিজের পাপের ক্ষমা চাইছেন অথবা নিজের পরকালের চিন্তা করে যিশুর কাছে কিছু চাইছেন৷ কিন্তু এমন ভাবলে ভুল হবে। তিনি নিজের জন্য কিছুই চাইছেন না। তিনি চাইছেন উনার স্ত্রীর জন্য, যে ৩৪ বছর আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর তার মৃত্যুবার্ষিকী।

বৃদ্ধ লোকটা মাইকেল যশ। বসবাস করেন রাজশাহীতে। রাতের গাড়িতে করে ঢাকা এসেছেন তিনি। প্রতিবছর ই এই দিনটাতে আসেন এই গির্জাটাতে। কারন এই জায়গাটা জশ এর বিশেষ। এই গির্জার পাশেই তার মৃত স্ত্রী সুমনার কবর রয়েছে।
প্রার্থনা শেষে এক গুচ্ছ ফুল হাতে নিয়ে সুমনার কবরের সামনে গিয়ে বসেলেন । দুর থেকে দেখলে মনে হবে তিনি তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছেন। চাশমা খুলে চোখ মুছলেন কয়েকবার। এভাবে চললো ঘন্টা খানেক। পরে উঠে চলে গেলেন মিস্টি কিনতে ফিরে আসলেন একটু পরে৷ গির্জাতে যারা আসবেন সবাইকে মিস্টি দিবেন তিনি। সারাদিন এখানে থাকবেন, আর এই জায়গায় তার যে স্মৃতি গুলো রয়েছে তা অনুভব করবেন৷ পরে আবার রাতের গাড়িতে ফিরে যাবেন৷

ঘটনার শুরু আরো অনেক বছর আগে। তখন যশ সবে আইএ পাস করেছে। সুদর্শন চেহারা ছেলেটার৷ যে কেউ দেখলে তাকিয়ে থাকে এমন৷ উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় আসে সে। রাজশাহীর একটা গ্রাম থেকে বেড়ে উঠেছে সে৷ সহয সরল সাধারন তবে মেধাবী আর মানুষ হিসাবেও খুবই ভালো সে৷ তার বাবা ছিল শিক্ষক মা গৃহিনী। তাদের একমাত্র ছেলে মাইকেল যশ। সে নতুন জিবনে খুব ব্যস্ত সময় পার করছিল। নতুন জায়গা, শিক্ষক, পড়ালেখা, নতুন নতুন বন্ধু৷ ভালই দিন কেটে যাচ্ছে। যশ ছিল ধার্মিক। প্রায়ই সময় করে বিকালে সে এই গির্জাতে আসত। এখানে একদিন এক সুন্দর বিকালে তার সাথে একটা সুন্দরী মেয়ের পরিচয় হয় তার নাম সুমনা ডিসুজা দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনই তার কথার মাধুর্য। তাকে যেকোনো মানুষই পছন্দ করবে। যশ ও এর ব্যতিক্রম হলো না৷ সুমনাকে তার পছন্দ হলো৷ তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের আরো একটা কারন সুমনা আর যশ একই ক্লাসে পড়ে৷ যশের পাশেরই একটা ভার্সিটিতে পড়ে সুমনা৷ বেশ বড় নাম করা প্রতিষ্ঠান৷ পড়তে অনেক খরচ ওখানে। তবে সুমনা বাবার আবার টাকার কমতি নেই৷ বড় ব্যবসায়ি তিনি৷ দুইটা মাত্র মেয়ে তাদের জন্য খরচ না কররে কার জন্য ৷ এভাবে গির্জাতে তাদের দেখা কথা হতে থাকল কিছু দিন৷ এর মধ্যেই দুজনই দুজনকে পছন্দ করতে শুরু করল আরো বেসি করে৷ তারা বাইরেও দেখা করা শুরু করল৷ মাঝে মাঝে ঘুরতেও যায়৷ এক বছর কেটে গেল এভাবে৷ বেশ কাটছে তাদের দিন। যশ ছুটিতে বাড়িতে গেলেও তার মন টেকে না দুই একদিন থেকেই ঢাকা চলে আসে। মা তাকে থাকতে বললেও সে থাকে না। কাজের বাহানা করে চলে আসে। যশ এর মনে হয় সে সুমনার প্রেমে পরেছে৷ তবে সে তাকে বলতে সাহস পায় না৷ তাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ একদিন সুমনা তাকে প্রেমের প্রস্তাব করে বসে। যশ কি বলবে বুঝতে পারে না, যেন নির্বাক হয়ে যায়৷ তখন সুমনা তাকে জড়িয়ে ধরে। যশ যেন সবকিছু স্বপ্নের মত দেখছিল। খুব সুন্দর চলছিল তাদের প্রেম। যশ সব সময় সুমনাকে হারানোর ভয়ে থাকত। তাই একদিন সে সুমনাকে বলল চলো আমরা যিশুর সামনে গিয়ে একসাথে শপথ করি আমরা কখনো কাউকে ছেড়ে যাব না।

কিন্তু সুমনা ছিল ভিষন স্মার্ট এবং সব কিছুতে এগিয়ে৷ সে গির্জাতে গিয়ে যশ এর হাত ধরে বলে দিল আজ থেকে তোমাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিলাম আমি তোমাকে ছাড়া আর কখনো কারো হবো না৷ যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি শুধু তোমার।

এর পরে যশ আর কোনোদিন ভয় পায়নি সুমনাকে নিয়ে। যে সুধু তাকে ভালোবাসতে থাকে আর তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেকতে থাকে৷
তার অনার্স শেষ হয়ে গেল। এই কয়টা বছর যেন তার কাছে কয়েক মাস মনে হয়। তবে সে খুব ভালো রেজাল্ট করতে পারেনা৷ কিন্তু তাকে থেমে থাকলে তো চলবে না, কত স্বপ্ন তার চাকরি করতে হবে সুমনা নিয়ে তার সংসার হবে৷ ছোট ছোট বাচ্চ থাকবে তাদের৷ যশ তার স্বপ্নের পিছনে ছুটতে থাকে৷ কিন্তু সে কোনো ভাবেই চাকরি জোগাড় করতে পারে না। সুমনা তাকে চাপ দিতে থাকে বিভিন্ন ভাবে। যশ কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিল না।
হঠাৎ এক রাতে যশকে সুমনার ছোট বোন ফোন দেয়, জানায়, সুমনা আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করেছে৷ দ্রুত ছুটে যায় যশ সেখানে গিয়ে দেখে সুমনাকে চেনা যাচ্ছে না। একেবারে পুরো দেহটা ঝলসে গেছে৷ পুলিশ তার দেহটা বের করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলো৷ যশের ইচ্ছা করছিল ওই পোড়া দেহটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে কিছুই করতে পারছিল না। সুধু চুপচাপ দাড়িয়ে দেখছিল৷ আর আর মনের ভিতরে সুমনার সব স্মৃতি ছবির মত ভাসছিল। পুলিশ গাড়িটা চলে গেল তবুও যশ তার দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছে। সুমনার বোনের ধাক্কায় সে হুস ফিরে পেল। সে যশ এর হাতে একটা কাগজ দিয়ে চলে গেল৷ এটা সুমনার লেখা সে এটা যশএর জন্য লিখে রেখে গেছে৷ তাতে সে জানিয়েছে,,,,

প্রিয় যশ,
তোমাকে ছাড়া বাচতে পারব না। কিন্তু বাড়ি থেকে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিতে চাইছে। তাই চলে গেলাম।
ইতি, তোমার বউ।

যশের সব কিছু ওই এক রাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। গির্জার পাশে সুমনাকে কবর দেওয়া হলো। যস প্রায় সব সময় ওখানেই থাকত। ৩, ৪ দিন পরে তার এক বন্ধু তাকে জানাল সুমনার বাড়ির লোক জেনে গেছে সুমনা তার জন্য আত্মহত্যা করছে। তাই তারা তাকে ক্ষতি করবে। সে যেন তার গ্রামে ফিরে যায়।
কিন্তু যশ তাতে ভয় পেলো না৷ সে সুমনাকে ছেড়ে যাবে না। সারাজিবন তার কবরের পাশে বসে থাকবে। এমন টাই ভেবেছে সে। তার পরেরদিন কয়েকজন লোক এসে তাকে খুব মারল। কয়েকদিন ঠিকমত খায় না সে। রোগা হয়ে গেছে। মাইর সহ্য করতে পারলো না। কিছু লোক ধরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করল৷ সুস্থ হলে তার বন্ধু জোর করে তাকে তার গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসল।
সে আবার চলে আসতে চাইল ঢাকা তে। কিন্তু তার মার মুখের দিকে তাকিয়ে সে আসতে পারল না৷ সুমনার ভালোবাসার জন্য সে কতবার মার ভালোবাসা অবজ্ঞা করেছে৷ মাকে মিথ্যা বলে সুমনার কাছে ছুটে গেছে৷ আজ সে সুমনা নাই।

সে মাকে জড়িয়ে ধরে কাদল। সে মনে মনে ভাবল মাকে আর কস্ট দিবে না। সে আর ঢাকা গেল না। কিছু দিন পরেই রাজশাহীতে তার একটা চাকরি হয়ে গেলো। মা বাবাকে নিয়ে দিন কাটাতে লাগলো। তবে তার রাত দিন সব সময় তার চিন্তাতে সুমনাই থাকত। সে সুমনার সাথে সব সময় কথা বলত। অনেকে তাকে পাগল বলত তাতে তার কিছু যায় আসে না। বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বললে বলত, আমি বিবাহিত। আর আমার বউ সব সময় আমার সাথেই থাকে৷ শত জোর করেও তাকে কেউ বিয়ে করাতে পারেনি। ।

যশ এর মা বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। সে এখন একাই বাস করে তার ছোট বাড়িতে। অবশ্য যশের মতে সে একা না বাড়িতে তারা দুজন থাকে৷ সে আর সুমনা।

বিকাল হয়ে এসেছে, মিস্টি দেওয়াও প্রায় শেষ। একটু পরেই যশ গাড়ি ধরবে তার বাড়ির। ফিরে যাবে তার বাড়ি। ঘটনাটা এখানে শেষ হলে পারত। কিন্তু না।

হঠাৎ এক বৃদ্ধ মহিলা গির্জায় ঢুকছে। যশ তাকে মিস্টি দিল। তখন সে যা দেখল তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। এই মহিলা তো সুমনা। সে ভাবল সে ভুল দেখছে। তাই চোখ মুছে আবার দেখল। না, সে সঠিক দেখছে৷ চোখে কম দেখলেও তার চোখ সুমনাকে চিনতে ভুল করবে না। তার মুখটা তো কখনো যশের মন থেকে সরেনি সারাজিবন জিবন তো সুমনা তার চোখে চোখে ই ছিল৷ ততক্ষনে মহিলাটা মিস্টি নিয়ে গির্জায় ঢুকে যাচ্ছে৷ যশ পিছন থেকে দেখতে থাকল। চুল দাড়ি বড় হয়ে পেকে গেছে চেহারা শুকিয়ে গেছে তাই হয়তোবা সুমনা যশকে চিনতে পারেনি। যশ দেখলে সুমনা গির্জায় প্রধান যিনি আছেন তার কাছে বসে খুব কান্না করছেন আর কিছু একটার জন্য আবেদন করে যাচ্ছেন বারবার। যশ সুধু সুমনাকে দেখেই যাচ্ছে৷ সুমনা বের হয়ে গেলে যশ সাথে সাথে লোকটার কাছে গেল৷ জানলে চাইলো মহিলাটা কি চায়? লোকটা বলতে চাইলো না প্রথমে। কিন্তু পরে যশ এর আকুল আবেদনে বলেই দিল।

লোকটা বলল, মহিলাটির বিয়ে হয়েছিল শহরের বড় ধনি ব্যক্তির সাথে। স্বামি সংসার ছিল। তার ক্যানসার হয়েছে সেই কারনে সবাই মহিলাটিকে ছেড়ে গেছে৷ সে এখন একা। তাই পাপের কথা মনে পরেছে তার৷ বহু বছর আগে কোন কারনে জীবিত অবস্থায় নিজেকে মৃত বানিয়ে এখানে কবর দিয়েছিল৷ এখন এসেছে কবর থেকে নিজের নামটা মুছে দিতে আর জিশুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে৷ আমি না করে দিয়েছি৷ এটা কি ছেলে খেলা বা মজা নাকি আপনি বলেন?

যশ কোনো উত্তর না দিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল সুমনাকে খুজল। কিন্তু তাকে সে খুজে পেলো না।

সেদিন রাতে যা ঘটেছিল সব ছিল একটা সাজানো ঘৃনিত নাটক। কোনো একটা মর্গ থেকে দেহটা এনে সেটাকে সুমনা বানিয়ে পুড়ানো হয়েছিল। তার এক সপ্তা পরে অন্য একটা শহরে ধুমধাম করে সুমনার বিয়ে হয়েছিল৷ আর পুরো নাটকটা সুমনা আর তার পরিবার মিলে করেছিল।

যশ অনেক সময় ধরে সুমনাকে খুজল। সে মনে মনে ভাবছিল, সে জানতে চাইবে কেন সুমনা তার সাথে এই জঘন্য নাটকটা করেছিল৷ পরেই মনে করল না থাক কি আর হবে জেনে৷ যা হবার হয়ে গেছে।

যশ ভাবল সবাই ছেড়ে গেছে তো কি হয়েছে সে সুমনাকে বুকে টেনে নিবে। কিন্তু তখন ই তার মনে, নাহ! এই সুমনা তো সেই সুমনা না যে যশের বউ৷ যে যশের বউ ছিল সে তো ওই রাতে পুড়ে গেছে।

এই সব ভাবতে ভাবতে সে বসে পড়ল। তার কাছে মনে হচ্ছে তার পুরো জিবন মিথ্যা হয়ে গেলো। কি করল সে সারা জিবন! কার জন্য করল৷ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না৷ চশমা টা আগেই কোথায় পরে গেছে। সে চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করল। নাহ, চশমার কারনে না। এমনিতেই সে চোখে ঝাপসা দেখছে। মাটিয়ে লুটিয়ে পরল সে। তখন তার ঝাপসা চোখে সে দেখতে পাচ্ছে সেই যুবতি সুমনা তার হাতটা ধরে বলছে, তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না৷ পরেই দেখতে পারল একটি ঘরে আগুনে পুরছে যুবতি সুমনা আর চিৎকার করছে । আর পাশে বসেই হাসছে বৃদ্ধ চেহারার এই ঘৃনিত সুমনা। তখনই আগুন থেকে হেটে বেরিয়ে আসল যুবতি সেই সুমনা এসে যশএর হাতটা ধরে বলল, চলো৷
চোখের পাতাটা বন্ধ হয়ে গেলো যশের৷
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গির্জার ঘন্টা বেজে উঠল টং টং করে৷

মন্তব্য করুন

একটি চিন্তা “প্রথম লেখা।

  1. সকলের মন্তব্য আমাকে ভুল গুলো শুধরে ভাল কিছু লিখতে সাহায্য করবে।