উপলব্ধি

17
0

যা পেয়েছি সে সবের চেয়ে আরো স্থির দিন পৃথিবীতে আসে;
আসে না কি?
চারিদিকে হিংসা দ্বেষ কলহ রয়েছে;
সময়ের হাত এসে সে সবের অমিলন, মলিন প্রেরণা
তবুও তো মুছে দিয়ে যেতে পারে,- ভাবি।
সেই আদিকাল থেকে আজকের মুহুর্ত অবধি
মানুষের কাহিনীর যতদূর অগ্রসর হয়ে গেছে তাতে
প্রান্তে ঠেকে দেখছি কেবলি :
মলিন বালির দান নিয়ে তার মরুভূমি সূর্যের কিরণে দাঁড়াতে
শিখেছে অনেক দিন;
তবুও তো
মানুষের কাছে মানুষের দাবি র’য়ে গেছে মনে ভেবে হৃদয়ে কুয়াশা
করুণ প্রশ্নের মত খেলা ক’রে গেছে ঢের দিন।
আমাদের পায়ে চলার পথ ঘিরে অব্যক্ত ব্যথার
কবেকার নচিকেতা- আজকের মানুষের হাড়
প্রাণের সমুদ্রে সুরে ফেনশীর্ষ ঢেউয়ের উপরে
সূর্যের দিগন্তে দেশে আমাদের তুলে নিতে চায়;
নিঃসহায় ডুবুরির মতো ডুবে মরে;
সমুদ্রপাখির শাদা, বিরহীর মতন ডানায়
সেই শূণ্য অন্ধকার দিকের ভিতরে
আমাদের ইতিহাস পিরামিড ভেঙে ফেলে;-
লণ্ডন- ক্রেমলিন গড়ে।

কেবলি আশঙ্কা, ব্যথা, নিরাশার সম্মুখীন হয়ে
মানুষের মরণের সমুদ্রের ঢেউ
রূপান্তরিত করে নিতে চেয়ে মানুষের জীবনের সুর
জেনেছে কোথাও ভয় নেই- নেই- নেই।
তবুও কোথাও ধর্মমন্দিরের অভয়পাণির সফলতা
আবার ভোরের সূর্যে সুমুখে রবে না কোনো দিন।
কবের প্রথম অবপ্রাণনায় জেগে
শাদা পাতা খুলেছিল যারা,
গল্প লিখে গিয়েছিল ঢের,
আদি রৌদ্র দেখেছিল,
সিন্ধুর কল্লোল শুনে গিয়েছিল ঢের, দিয়ে গিয়েছিল,
আকাশের মুখোমুখি অন্য এক আকাশের মত যারা নীল হয়ে
রাত্রি হয়ে নক্ষত্রের মত হয়ে মিশে গিয়েছিল :
তারা আর তাদের মরণ আজ আমাদের
পাশের পথের নিচে যতদূর ভুল
তাহাদের অস্তসূর্য ততদূর আমাদের উদয়ের মতন অরুণ;
শ্বেতাশ্বতর থেকে দীপঙ্কর অবধি সবই শাদা স্বাভাবিক
মনে হয় ব’লে মৃত স্বভাবের মতন করুণ ।
বিকেলের ক্ষয়ের ভিতরে এসে আজ তবে আমাদের দিন
অনিবার ইতিহাস অঙ্গারের প্রতিভাকে সঞ্চয়ের মত মনে ভেবে
মরণকে যা দেবার- জীবনকে যা দেবার সব
কঠিন উৎসবে-দীন অন্তঃকরণে দিয়ে দেবে।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন