সিন্দুরের বেসাতি

1
0

ওলো সোনার বরণী,
তোমার সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
রাঙা তোমার ঠোঁটরে কন্যা, রাঙা তোমার গাল,
কপালখানি রাঙা নইলে লোকে পাড়বে গালরে;
তোমার সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
সাঁঝের কোলে মেঘরে-তাতে রঙের চূড়া,
সেই মেঘে ঘষিয়া সিন্দুর করছি গুঁড়া গুঁড়ারে,
তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
এই না সিন্দুর পরিয়া নামে আহাশেতে আড়া,
এই সিন্দুরের বেসাতি করতে হইছি ঘর-ছাড়ারে;
তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
কাণা দেয়ায় ঝিলিক মারে কালা মেঘায় ফাঁড়ি,
তোমার জন্য আনছি কন্যা মেঘ-ডম্বুর শাড়ীরে;
তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!
শাড়ীখানি পর কন্যা, সিন্দুর খানি পর,
আঙ্খের পলক দেইখা আমি যাই হাপনার ঘররে;
তোমরা সিন্দুর নি নিবারে সজনি!

থাক থাক বানিয়ারে নিরালে বসিয়া
মা-ধনের আগে আমি আসি জিজ্ঞাসিয়া।
শোন শোন ওহে মা-ধন! শুনিয়া ল তোর কানে,
আমি তো যাব মা-ধন বানিয়ার দোকানে।
এক ধামা দাও ধান আমি কিনিব পুঁতির মালা
আরো ধামা দাও ধান আমি কিনিব হাতের বালা।

বিদেশী বানিয়ারে! বোঝা তোমার মাথে,
দেখাও দেখি কি কি জিনিস আছে তোমার সাথে?

আমার কাছে সিন্দুর আছে ওই না ভালের শোভা,
তোমার রাঙা-ঠোঁটের মত দেখতে মন-লোভা।

আমরা তো জানি না সিন্দুর কেমনে পরে,
আমরা তো দেখি নাই সিন্দুর কাহারো ঘরে।

সোনার বরণ কন্যারে! দীঘল মাথার ক্যাশ,
সিন্দুর পরাইতে পারি যাও যদি মোর দ্যাশ।
ঘরে আছে ভাইয়ের বৌ লক্ষ্মীর সমান,
তোমার মাথায় সিন্দুর দিয়া জুড়াইব প্রাণ।

শোন শোন বানিয়ারে কই তোমার আগে,
তোমার না সিন্দুর লইতে কত দাম লাগে?

আমার না সিন্দুর লইতে লাগে হাসিমুখ,
আমার না সিন্দুর লইতে লাগে খুশীবুক।

নিলাম নিলাম, সিন্দুর নিলাম হাসি-মুখে কিনি,
আরো কি ধন আছে তোমার আমরা নি তা চিনি?

আরো আছে হাতের শাঁখা, আছে গলার হার,
নাকের বেশর নথও আছে সোনার বাঁধা তার।

আমরা তো নাহি জানি বানিয়া শাঁখা বলে কারে,
দেখি নাই তো নথের শোভা সোনাবান্ধা তারে।

সোনার বরণ কন্যা, তোমার সোনার হাত পাও,
শাঁখা যদি না পরিলে কিসের সুখ পাও?
সাতো ভাইয়ের সাতো বউ সাতো নথ নাকে,
পূব-দুয়াইয়া বাড়ি মোদের উজ্জল কইরা থাকে।

শোন শোন বানিয়ারে কই তোমার আগে,
তোমার না নথ ও শাঁখায় কত দাম লাগে?

আমার না শাঁখা লইতে লাগে হাসিমুখ,
আমার না নথ লইতে লাগে খুশীবুক।
নিলাম, নিলাম, নথও নিলাম, নিলাম, তোমার শাঁখা,
তোমার কথা বানিয়ারে রিদ্রে রইলো আঁকা।

ওই বিদেশী বানিয়া মোরে
পাগল করিয়া গেছে,
আমার মন কাড়িয়া নেছেরে সজনি!
শাঁখা না কিনিতে আমি হাতে বাঁধলাম ডোর;
সিঁথার সিন্দুর কিনে চক্ষে দেখি ঘোর!
নথ না কিনিয়া আমি পন্থে করনু বাসা,
একেলা কান্দিয়া ফিরি লয়ে তারি আশা।

জসীম উদ্দিন
WRITTEN BY

জসীম উদ্দিন

জসীম উদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩ - ১৩ মার্চ ১৯৭৬) একজন বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। তিনি আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগর সভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্‌দীনের।

জসীম উদ্‌দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আনসার উদ্দিন মোল্লা ছিলেন একজন শিক্ষক এবং মা আমিনা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী।

জসীম উদ্‌দীন ১৯১৮ সালে মধুখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯২২ সালে ফরিদপুর কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিন্তু অর্থাভাবে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।

জসীম উদ্‌দীন ১৯২৭ সালে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলার তেলিহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯২২ সালে। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল "প্রভাত"। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল:

সোনার তরী
নদীর স্বপ্ন
গাঁয়ের মেয়ে
ঘুমের দেশে
ধানক্ষেত
ধানসিঁড়ি
নদীর পৃষ্ঠে
মেঘের মেয়ে
ঝড়
জসীম উদ্‌দীনের কবিতাগুলি আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের চিত্র তুলে ধরে। তার কবিতাগুলিতে তিনি গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন।

জসীম উদ্‌দীন একজন সফল গীতিকারও ছিলেন। তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় গান রচনা করেছেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গানগুলি হল:

সোনার তরী
ধানসিঁড়ি
ঘুমের দেশে
ধানক্ষেত
নদীর পৃষ্ঠে
মেঘের মেয়ে
ঝড়
ওরা বলে চাষার দুলাল
মাগো আমার মুখের চামড়া কালো
জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।

জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন।

জসীম উদ্‌দীন ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্য করুন