পলাতকা

1
0

হাসু বলে একটি খুকু আজ যে কোথা পালিয়ে গেছে-
না জানি কোন অজান দেশে কে তাহারে ভুলিয়ে নেছে।
বন হতে সে পলিয়ে গেছে, বনে কাঁদে বনের লতা,
ফুল ফুটে কয় সোনার খুকু! ছেড়ে গেলি মোদের কোথা?
বনের শাখা দুলিয়ে পাতা-করত বাতাস তাহার গায়ে।
তাহার শাড়ীর আঁচল লাগি ঝুমকো লতা দুলত বনে,
গাছে গাছে ফুল নাচিত তাহার পদধ্বনির সনে।

বনের পথে ডাকত পাখি, তাদের সুরের ভঙ্গী করে-
কচি মুখের মিষ্টি ডাকে সারাটি বন ফেলত ভরে।
প্রতিধ্বনি তাহার সনে করত খেলা পালিয়ে দূরে,
সুরে সুরে খুঁজত সে তার বনের পথে একলা ঘুরে।
সেই হাসু আজ পালিয়ে গেছে, পাখির ডাকের দোসর নাহি,
প্রতিধ্বনি আর ফেরে না তাহার সুরের নকল গাহি।

হাসু নামের একটি খুকু পালিয়ে গেছে অনেক দূরে,
কেউ জানে না কোথায় গেছে কোন্ বা দেশে কোন্ বা পুরে।
বাপ জানে না, মায় জানে না কোথায় সে যে পালিয়ে গেছে,
সেও জানে না, কোন সুদূরে কে তাহারে সঙ্গে নেছে।
কোনোখানে কেউ ভাবে না, কেউ কাঁদে না তাহার তরে,
কেউ চাহে না পথের পানে, কখন হাসু ফিরবে ঘরে।
মায় কাঁদে না, বাপ কাঁদে না, ভাই-বোনেরা কাঁদছে না তার,
খেলার সাথী কেউ জানে না, সে কখনও ফিরবে না আর।
ফিরবে না সে, ফিরবে নারে, খেলা ঘরের ছায়ার তলে,
মিলবে না সে আর আসিয়া তার বয়সের শিশুর দলে।
পেয়ারা-ডালে দোলনা খালি, ইঁদুরে তার কাটছে রশি,
চোড়ুই ভাতির হাঁড়ির পরে কাক দুটি আজ ডাকছে রশি,
খেলনাগুলি ধূলায় পড়ে, হাত-ভাঙা কার, পা ভাঙা কার,
ঝুমঝুমিটি বেহাত হয়ে বাজছে হাতে যাহার তাহার।
এসব খবর কেউ জানে না, সে জানে না, কেমন করে
কখন যে সে পালিয়ে গেলে তাহার চিরজনম তরে।
জানে তাহার পুতলগুলো অনাদরে ধুলায় লুটায়,
বুকে করে আর না চুমে, পুতুল-খেলার সেই ছোট মায়।
মাতৃ হারা মিনি-বিড়াল কেবা তাহার দুঃখ বুঝে,
কেঁদে কেঁদে বেড়ায় সে তার ছোট্ট মায়ের আঁচল খুঁজে।
খেলা ঘর আজ পড়ছে ভেঙে, শিশু কল-তানের সনে,
পুতুল বধূ আর সাজে না পুতুল-বরের বিয়ের কনে।

হাসু নামের সোনার খুকু আজ যে কোথা পালিয়ে গেছে,
সাত-সাগরের অপর পারে কে তাহারে ভুলিয়ে নেছে।
পালিয়ে গেছে সোনার হাসুঃ- খেলার সাথী আয়রে ভাই-
আজের মত শেষ খেলাটি এইখানেতে খেলে যাই।
সেখানটিতে খেলেছিলাম ভাঁড়-কাটি সঙ্গে নিয়ে,
সেইখানটি দে রুধে ভাই ময়না কাঁটা পুতে দিয়ে।

জসীম উদ্দিন
WRITTEN BY

জসীম উদ্দিন

জসীম উদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩ - ১৩ মার্চ ১৯৭৬) একজন বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। তিনি আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগর সভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্‌দীনের।

জসীম উদ্‌দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আনসার উদ্দিন মোল্লা ছিলেন একজন শিক্ষক এবং মা আমিনা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী।

জসীম উদ্‌দীন ১৯১৮ সালে মধুখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯২২ সালে ফরিদপুর কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিন্তু অর্থাভাবে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।

জসীম উদ্‌দীন ১৯২৭ সালে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলার তেলিহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯২২ সালে। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল "প্রভাত"। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল:

সোনার তরী
নদীর স্বপ্ন
গাঁয়ের মেয়ে
ঘুমের দেশে
ধানক্ষেত
ধানসিঁড়ি
নদীর পৃষ্ঠে
মেঘের মেয়ে
ঝড়
জসীম উদ্‌দীনের কবিতাগুলি আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের চিত্র তুলে ধরে। তার কবিতাগুলিতে তিনি গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন।

জসীম উদ্‌দীন একজন সফল গীতিকারও ছিলেন। তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় গান রচনা করেছেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গানগুলি হল:

সোনার তরী
ধানসিঁড়ি
ঘুমের দেশে
ধানক্ষেত
নদীর পৃষ্ঠে
মেঘের মেয়ে
ঝড়
ওরা বলে চাষার দুলাল
মাগো আমার মুখের চামড়া কালো
জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।

জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন।

জসীম উদ্‌দীন ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্য করুন