সীবন-রতা

1
0

সেলাই করিছে মেয়ে
জাম-দানী শাড়ী রেখায় হাসিছে সোনার অঙ্গ ছেয়ে।
এক পাশ হইতে দেখিতেছি তারে, বাঁকাধনু নাসিকায়
ভূরু-তীর দুটি সদা উদ্যত বধিতে কে অজানায়।
আঁখি সরোবর স্তব্ধ নিঝুম, মৃদু পলকের ঘায়ে,
ঢেউ-হংসীরা বিরাম লভিছে কাজল রেখায় গাঁয়ে।
অধরখানিতে যুগল ঠোঁটের রঙিন বাঁধন খুলি,
মাঝে মাঝে মৃদু হাসিটে ফুটিছে সুমধুর সুখে দুলি।

খোঁপার ফিতার কুসুম বাঁধনে গোলাপ মেলিছে দল,
বেনীর ভ্রমর সেথা জড় হয়ে রয়েছে অচঞ্চল।
এক হাতে ধরি সরু সুইটিরে সেলাই করিছে বসে,
আকাশ হইতে তারা-ফুলগুলি পড়িছে সেথায় খসে।
রঙের রঙের আলপনা যত তার ভালবাসা হয়ে,
জনমের মতো বন্দী হইছে কাঁথায় কুহকালয়ে।

কে মাখিয়া দেছে হলুদের গুড়ো তাহার সারাটি গায়,
রঙিন শাড়ীর ফাঁকে ফাঁকে তাহা আকাশ ধরনী বায়।
অনাহত কোন গান বাজে তার দেহের বীনার তারে,
কালের সারথি থামায়েছে চলা সেই সুর শনিবারে।
সে সুর শুধুই হৃদয় গহনে কিছু অনুভব হয়,
কাহারো নিকট ভাষার বসন কভু সে পরিল নয়।
তাহারই একটু রেশ মেখে বুকে বাঁশী যে আত্মহারা,
শূণ্য বুকের শূন্য ভরিতে কাঁদে তার সুর-ধারা।
মোহের মতন স্বপনের মতো আবছা রঙিন মেঘে,
যেমনি ছড়ায় মধুর সুষমা সিদুরিয়া রোদ লেগে;
কোনসে মহান ভাস্কর যেন তাজমহলের থেকে,
পাথর কাটিয়া অতি ধীরে ধীরে লইতেছে তারে এঁকে।

বারবার করে ভেঙে যায় ছবি, হয় না মনের মত,
আবার তাহারে গড়িবার লাগি হয় তপস্যা-রত।
ওই বাহু দুটি মমতা হইয়া মেলিবে শাড়ীর মেঘে,
ও অধরখানি ভালবাসা করে পাষাণে লইবে এঁকে।
নাসিকার ওই স্বর্ণ দেউলে স্থাপি মন্মথ-ছবি।
যুব-যুগান্ত রূপ-হোমানলে ঢলিবে জীবন-হবি।

বসিয়া রয়েছে সীবন-রতা সে মেয়ে,
রঙিন ফুলটি ভাসিয়া এসেছে রামধনু নদী বেয়ে।
চরণ দুখানি যুগল হংসী শাড়ীর সাগর পাটে,
সাঁতারি এখন আসিয়া বসেছে পাড়ের রঙিন ঘাটে,
রাঙা টুকটুকে আলতা রেখার রঙিন তটের পানি,
ভালবাসা-ফুল ফুটিছে টুটিছে ভরিয়া ধরণীখানি।
সাবধান হাতে সরু সুই লয়ে নক্সা আঁকে সে ধরে,
কাঁথা উপরে আরেক ধরণী হাসিতেছে খুশী ভরে।
আরেক শিল্পী তাহারে লইয়া কালের খাতার পরে,
আর এক কাঁথা বুনট করিছে সে রূপ মাধুরী ধরে।

জসীম উদ্দিন
WRITTEN BY

জসীম উদ্দিন

জসীম উদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩ - ১৩ মার্চ ১৯৭৬) একজন বাঙালি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও লেখক। তিনি আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগর সভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্‌দীনের।

জসীম উদ্‌দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আনসার উদ্দিন মোল্লা ছিলেন একজন শিক্ষক এবং মা আমিনা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী।

জসীম উদ্‌দীন ১৯১৮ সালে মধুখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯২২ সালে ফরিদপুর কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিন্তু অর্থাভাবে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।

জসীম উদ্‌দীন ১৯২৭ সালে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলার তেলিহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ১৯৩১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯২২ সালে। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল "প্রভাত"। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল:

সোনার তরী
নদীর স্বপ্ন
গাঁয়ের মেয়ে
ঘুমের দেশে
ধানক্ষেত
ধানসিঁড়ি
নদীর পৃষ্ঠে
মেঘের মেয়ে
ঝড়
জসীম উদ্‌দীনের কবিতাগুলি আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের চিত্র তুলে ধরে। তার কবিতাগুলিতে তিনি গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন।

জসীম উদ্‌দীন একজন সফল গীতিকারও ছিলেন। তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় গান রচনা করেছেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গানগুলি হল:

সোনার তরী
ধানসিঁড়ি
ঘুমের দেশে
ধানক্ষেত
নদীর পৃষ্ঠে
মেঘের মেয়ে
ঝড়
ওরা বলে চাষার দুলাল
মাগো আমার মুখের চামড়া কালো
জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।

জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন।

জসীম উদ্‌দীন ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্য করুন