নূরলদীনের সারা জীবন

83
0

নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর
নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে উনসত্তর হাজার।
ধবলদুধের মতো জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদ – পূর্ণিমার।
নষ্ট ক্ষেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন সংসার
তখন হঠাৎ কেন দেখা দেয় নিলক্ষার নীল তীব্র শিস
দিয়ে এত বড় চাঁদ?
অতি আকস্মাৎ
স্তব্ধতার দেহ ছিঁড়ে কোন ধ্বনি? কোন শব্দ? কিসের প্রপাত?
গোল হয়ে আসুন সকলে,
ঘন হয়ে আসুন সকলে,
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে।
অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মানুষের বন্ধ দরজায়।
এই তীব্র স্বচ্ছ পূর্ণিমায়
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়।
কালঘুম যখন বাংলায়
তার দীর্ঘ দেহ নিয়ে আবার নূরলদীন দেখা দেয় মরা আঙিনায়।
নূরলদীনের বাড়ি রংপুরে যে ছিল,
রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল
১১৮৯ সনে।
আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।
আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রক্ষ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনেরও কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, “জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?”

সৈয়দ শামসুল হক
লিখেছেন

সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক। তাকে "সব্যসাচী লেখক" বলা হয় কারণ তিনি কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য পরিচিত ছিলেন।

তিনি ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

তার সাহিত্যিক জীবন ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত 'অগত্যা' পত্রিকায় একটি গল্প প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয়। এরপর তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প এবং অনুবাদ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে:

* **কবিতা:** বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা, নদীর কাছে, নীল আকাশের কাছে, অচেনা
* **উপন্যাস:** খেলারাম খেলে যা, তিন পয়সার জ্যোছনা, জলেশ্বরী, অদৃশ্য বস্তু
* **নাটক:** সাতটি নাটক, হডসনের বন্দুক, হ্যামলেট
* **গল্প:** শ্রেষ্ঠ গল্প, অচেনা, নীল আকাশের কাছে
* **অনুবাদ:** ওথেলো, হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, রিচার্ড III

তার সাহিত্যকর্মে তিনি বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি-বিকার সবই খুব সহজ কথা ও ছন্দে উঠে এসেছে। তিনি বাঙালি সাহিত্যে আধুনিকতার অন্যতম পথিকৃত।

সৈয়দ শামসুল হক ১৯৬৬ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক, ২০০৫ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং ২০০৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

তিনি ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্য করুন