সাহিত্য রস

সবচেয়ে বড় কবিতা, গল্প, ছন্দ এবং গান প্রকাশের ওয়েবসাইট

স্মৃতির শহর ১

1
0

আমাকে টান মারে রাত্রি-জাগা নদী
আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার
আমার ঘুম ভেঙে হঠাৎ খুলে যায়
মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার।

বাতাসে ছেঁড়া মেঘ, চাঁদের চারপাশে
সহসা দানা বাঁধে নীল সময়
বাইরে এসে দেখি পৃথিবী শুন্-শান্
রাস্তাগুলি যেন আকাশময়।

প্রথম ডেকেছিল মধ্য কৈশোরে
পাগল করা এক ব্যথার দিন
শরীরে বেজেছিল সমর বিউগল
প্রথম স্বপ্নেরা হলো স্বাধীন।

চক্ষে কেউ নেই তবুও বিচ্ছেদ
পাইনি কেন তাকে চিনি না যাকে
তখন মনে পড়ে নিশীথ-সংকেত
দুরাশা ঘুরে ফেরে নদীর বাঁকে।

শাসন বন্ধন তুচ্ছ হয়ে গেল
আমার চেনা পথ গোলক ধাঁধা
দৃষ্টি বিভ্রম সীমানা ছুঁয়ে যায়
খড়্গে কেটে দিই অলীক বাধা।

এদিকে সোনাগাছি কাচের ঝন্ ঝন
পেরিয়ে চলে যাই আহিরিটোলা
নতুন ঘ্রাণ মাখা শহর কেঁপে ওঠে
পূর্ব পশ্চিমে দুনিয়া খোলা।

এখন জেগে ওঠে কীট ও কুসুমেরা
আঁধার শুষে নেয় দিনের তাপ
জ্যোৎস্না রেণু ওড়ে, ধুলোয় হীরেকুচি
এখন ছুটি নেয় পুণ্য পাপ।

দু’পাশে গলি ঘুঁজি হোঁচট লাগে পায়
পল্কা সংসার এখানে কার?
জন্ম মৃত্যুর প্রগাঢ় কৌতুকে
হাসি ও কান্নার সারাৎসার।

এ যেন নিশিডাক, মৃতের হাতছানি
এ যেন কুহকের অজানা বীজ
এমন মোহময় কিছুই কিছু নয়
হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া-খনিজ।

আমাকে যেতে হবে এখনো যেতে হবে
রয়েছে অশরীরী অপেক্ষায়
যেখানে ব্যাকুলতা ঢেউয়ের তালে দোলে
যেখানে ধ্বনিগুলি স্মৃতিকে খায়।

পথের রাজা এক নগ্ন মহাকাল
ধরেছে মুদারায় ডাগর গান
হেঁতাল দণ্ডটি আকাশে তুলে ধ’রে
সে যেন নিতে চায় সাগর-ঘ্রাণ।

একটু নিচু হয়ে দিয়েছি সম্মান
আবার সরে গেছি অপর দিকে
পারিয়া কুকুরেরা অবাক চোখে দেখে
গাছের মতো এই মানুষটিকে।

দুদিকে মন্দির, গরাদে ভীমতালা
কালীর স্তনঘেরা পিঁপড়ে রাশি
প্রদীপে মৃদু আলো, সিঁড়িতে বেজে ওঠে
কুষ্ঠরোগিণীর শুকনো কাশি।

একলা শালপাতা আপন মনে ওড়ে
পুজোর গাঁদা ফুল ধুলোয় মাখা
একটি ঘুমচোখ বালক হিসি করে
দেয়ালে রমণীর শরীর আঁকা।

এবারে দেখা যায় শ্মশানে উৎসব
আগুন জবা রং, গুঞ্জরণ
ছায়ার কোলাহল, ছায়ার ঘোরাফেরা
ব্যস্ত নিরাকার মানুষজন।

এখানে রাত নেই, এখানে দিন নেই
থেমেছে চুম্বকে আয়ুর ঘড়ি
মৃতেরা হেসে ওঠে, জীবিত উদাসীরা
হেলায় ছুঁড়ে দেয় পারের কড়ি।

গাঁজার বীজ ফাটে, শিবের শিষ্যেরা
বৃত্তে বসে আছে ছবির প্রায়
যমজ ত্রিভূজের চূড়ায় লাল আলো
জোনাকি ফুটে ওঠে নদীর গায়।

চোখের চেয়ে আরও অনেক বড় দেখা
দৃশ্য ঘুরে যায়, ঘোরে বাতাস
ধোঁয়ার মৃদু জ্বালা শোকের রলরোল
বাষ্প-অশ্রুতে রুদ্ধশ্বাস।

জলের কাছে যাই, সেখানে কেউ নেই
সেখানে শুয়ে আছে নদীর কায়া
আমাকে ডেকেছিল স্বপ্ন ছেঁড়া এক
পাহাড়-কুন্তলা গভীর ছায়া।

ছায়াও জেগে ওঠে জলের সশরীর
শহর বিস্মৃত আকাশলীনা
আমার করতল দেয় ও নেয় কিছু
জীবন কেটে যায় তাকে ভুলি না।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
WRITTEN BY

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, এবং সাংবাদিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলায়। তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পড়াশোনা কলকাতায়। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় কবিতার মাধ্যমে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "স্মৃতিস্তম্ভ" প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল:

* "অর্জুন" (১৯৫৪)
* "প্রথম আলো" (১৯৫৬)
* "সেই সময়" (১৯৬৩)
* "পূর্ব-পশ্চিম" (১৯৭১)
* "আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি" (১৯৭৭)
* "ভানু ও রাণু" (১৯৮২)
* "অন্ধকারের আলো" (১৯৯৭)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাগুলি আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁর কবিতাগুলি সাধারণ মানুষের জীবন, প্রেম, ভালোবাসা, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, ও সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায়। তাঁর কবিতার ভাষা ছিল সরল ও সহজবোধ্য।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন সফল ঔপন্যাসিকও ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল:

* "হঠাৎ নীরার জন্য" (১৯৬৩)
* "শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা" (১৯৬৬)
* "অর্ধেক জীবন" (১৯৭৩)
* "অরণ্যের দিনরাত্রি" (১৯৭৬)
* "কাকাবাবু" (১৯৮১)
* "মনের মানুষ" (১৯৮৬)
* "আয়নায় মুখ" (১৯৯০)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছোটগল্পকার হিসেবেও সফল ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পগুলির সংকলনগুলি হল:

* "এখনও দুপুর" (১৯৬৮)
* "আমার ছেলেবেলা" (১৯৭২)
* "রূপসী বাংলা" (১৯৭৫)
* "আমার সময়" (১৯৮০)
* "ছোটগল্পসমগ্র" (১৯৯৩)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন সমস্যার প্রতি আলোকপাত করেছেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সমর্থক ছিলেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার পথকে মসৃণ করেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, এবং সাংবাদিক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

* সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮)
* পদ্মভূষণ (১৯৯১)
* বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ (১৯৯৬)
* রবীন্দ্র পুরস্কার (২০০২)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্য করুন