সাহিত্য রস

সবচেয়ে বড় কবিতা, গল্প, ছন্দ এবং গান প্রকাশের ওয়েবসাইট

ভোরাই

1
0

ভোর হল রে, ফর্সা হ’ল, দুল্ ল ঊষার ফুল-দোলা !
আন্ কো আলোয় যায় দেখা ওই পদ্মকলির হাই-তোলা !
জাগলো সাড়া নিদ্ মহলে, অ-থই নিথর পাথার-জলে–
আলপনা দ্যায় আল্ তো বাতাস,ভোরাই সুরে মন ভোলা !
ধানের ক্ষেতের সব্ জে কে আজ সোহাগ দিয়ে ছুপিয়েছে !
সেই সোহাগের একটু পরাগ টোপর-পানায় টুপিয়েছে !
আলোর মাঠের কোল ভরেছে, অপরাজিতার রং ধরেছে–
নীল-কাজলের কাজল-লতা আস্ মানে চোখ ডুবিয়ে যে |
কল্পনা আজ চলছে উড়ে হাল্ কা হাওয়ায় খেল্ খেলে !
পাপ্ ড়ি-ওজন পান্ সি কাদের সেই হাওয়াতেই পালপেলে !
মোতিয়া মেঘের চামর পিঁজে পায়রা ফেরে আলোয় ভিজে
পদ্মফুলের অঞ্জলি যে আকাশ-গাঙে যায় ঢেলে !
পূব্ গগনে থির নীলিমা ভুলিয়েছে মন ভুলিয়েছে !
পশ্চিমে মেঘ মেলছে জটা–সিংহ কেশর ফুলিয়েছে !
হাঁস চলেছে আকাশ-পথে, হাস্ ছে কারা পুষ্প-রথে,–
রামধনু-রং আঁচলা তাদের আলো-পাথার দুলিয়েছে !
শিশির-কণায় মানিক ঘনায়, দূর্বাদলে দীপ জ্বলে !
শীতল শিথিল শিউলী-বোটায় সুপ্ত শিশুর ঘুম টলে |
আলোর জোয়ার উঠছে বেড়ে গন্ধ-ফুলের স্বপন কেড়ে,
বন্ধ চোখের আগল ঠেলে রঙের ঝিলিক্ ঝল্ মলে !
নীলের বিথার নীলার পাথার দরাজ এ যে দিল্ খোলা !
আজ কি উচিত ডঙ্কা দিয়ে ঝাণ্ডা নিয়ে ঝড় তোলা ?
ফির্ ছে ফিঙে দুলিয়ে ফিতে; বোল ধরেছে বুল্ বুলিতে !
গুঞ্জনে আর কূজন-গীতে হর্ষে ভূবন হর্ বোলা !

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
WRITTEN BY

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ছড়াকার, অনুবাদক, এবং ছান্দসিক। তিনি রবীন্দ্রযুগের অন্যতম বিশিষ্ট কবি। তাঁর কবিতায় ছন্দের কারুকাজ, শব্দ ও ভাষা যথোপযুক্ত ব্যবহারের কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ছন্দের যাদুকর নামে আখ্যায়িত করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নিমতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রজনীনাথ দত্ত ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন একজন গৃহবধূ। সত্যেন্দ্রনাথের পৈতৃক নিবাস বর্ধমানের চুপী গ্রামে।

সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৯৯) এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে এফএ (১৯০১) পাস করেন; কিন্তু পরে বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তিনি প্রথমে পিতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন এবং পরে ব্যবসা ছেড়ে কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সবিতা" ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল "সন্ধিক্ষণ" (১৯০৫), "বেণু ও বীণা" (১৯০৬), "হোমশিখা" (১৯০৭), "ফুলের ফসল" (১৯১১), "কুহু ও কেকা" (১৯১২), "তুলির লিখন" (১৯১৪), "মনিমঞ্জুষা" (১৯১৫), "পুণ্যস্নান" (১৯১৯), এবং "সোনার তরী" (১৯২১)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় নানাবিধ ছন্দোনির্মাণ ও ছন্দ উদ্ভাবনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বাংলা ভাষার নিজস্ব বাগধারা ও ধ্বনি সহযোগে নতুন ছন্দসৃষ্টি তাঁর কবিপ্রতিভার মৌলিক কীর্তি। এজন্য তিনি "ছন্দের জাদুকর" ও "ছন্দোরাজ" নামে সাধারণ্যে পরিচিত।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি মেথরদের মতো অস্পৃশ্য ও অবহেলিত সাধারণ মানুষ নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিদেশি কবিতার সফল অনুবাদকও ছিলেন। তিনি আরবি, ফারসি, চীনা, জাপানি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যএর বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ঘটান।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯২২ সালের ২৫ জুন কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি।

মন্তব্য করুন