কালোর আলো

91
0

কালোর বিভায় পূর্ণ ভুবন, কালোরে কি করিস ঘৃণা?
আকাশ-ভরা আলো বিফল কালো আঁখির আলো বিনা।
কালো ফণীর মাথায় মণি,
সোনার আধার আঁধার খনি,
বাসন্তী রং নয় সে পাখীর বসন্তে যে বাজায় বীণা,
কালোর গানে পুলক আনে, অসাড় বনে বয় দখিনা!

কালো মেঘের বৃষ্টিধারা তৃপ্তি সে দেয় তৃষ্ণা হরে,
কোমল হীরার কমল ফোটে কালো নিশির শ্যমসায়রে!
কালো অলির পরশ পেলে
তবে মুকুল পাপড়ি মেলে,
তবে সে ফুল হয় গো সফল রোমাঞ্চিত বৃন্ত পরে!
কালো মেঘের বাহুর তটে ইন্দ্রধনু বিরাজ করে।

সন্ন্যাসী শিব শ্মশানবাসী,–সংসারী সে কালোর প্রেমে,
কালো মেঘের কটাক্ষেরি ভয়ে অসুর আছে থেমে।
দৃপ্ত বলীর শীর্ষ পরে
কালোর চরণ বিরাজ করে,
পূণ্য-ধারা গঙ্গা হল- সেও তো কালো চরণ ঘেমে,
দুর্বাদলশ্যামের রূপে– রূপের বাজার গেছে নেমে।

প্রেমের মধুর ঢেউ উঠেছে কালিন্দীরি কালো জলে,
মোহন বাঁশীর মালিক যে জন তারেও লোকে কালোই বলে,
বৃন্দাবনের সেই যে কালো–
রূপে তাহার ভুবন আলো,
রাসের মধুর রসের লীলা, -তাও সে কালো তমাল তলে,
নিবিড় কালো কালাপানির কালো জলেই মুক্তা ফলে।

কালো ব্যাসের কৃপায় আজো বেঁচে আছে বেদের বাণী,
দ্বৈপায়ন – সেই কৃষ্ণ কবি- শ্রেষ্ঠ কবি তাঁরেই মানি,
কালো বামুন চাণক্যেরে
আঁটবে কে কূট-নীতির ফেরে?
কালো অশোক জগৎ-প্রিয়, রাজার সেরা তাঁরে জানি,
হাবসী কালো লোকমানের মানে আরব আর ইরাণী।

কালো জামের মতন মিঠে- কালোর দেশ এই জম্বুদ্বীপে-
কালোর আলো জ্বলছে আজো, আজো প্রদীপ যায় নি নিবে,
কালো চোখের গভীর দৃষ্টি
কল্যানেরি করছে সৃষ্টি,
বিশ্ব-ললাট দীপ– কালো রিষ্টিনাশা হোমের টিপে,
রক্ত চোখের ঠান্ডা কাজল– তৈরী সে এই ম্লান প্রদীপে!

কালোর আলোর নেই তুলনা- কালোরে কী করিস ঘৃণা!
গগন-ভরা তারার মীনা বিফল- চোখের তারা বীনা,
কালো মেঘে জাগায় কেকা,
চাঁদের বুকেও কৃষন-লেখা,
বাসন্তী রং নয় সে পাখীর বসন্তের যে বাজায় বীণা,
কালোর গানে জীবন আনে নিথর বনে বয় দখিনা!

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
লিখেছেন

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ছড়াকার, অনুবাদক, এবং ছান্দসিক। তিনি রবীন্দ্রযুগের অন্যতম বিশিষ্ট কবি। তাঁর কবিতায় ছন্দের কারুকাজ, শব্দ ও ভাষা যথোপযুক্ত ব্যবহারের কৃতিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ছন্দের যাদুকর নামে আখ্যায়িত করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নিমতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রজনীনাথ দত্ত ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন একজন গৃহবধূ। সত্যেন্দ্রনাথের পৈতৃক নিবাস বর্ধমানের চুপী গ্রামে।

সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৯৯) এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে এফএ (১৯০১) পাস করেন; কিন্তু পরে বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তিনি প্রথমে পিতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন এবং পরে ব্যবসা ছেড়ে কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সবিতা" ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল "সন্ধিক্ষণ" (১৯০৫), "বেণু ও বীণা" (১৯০৬), "হোমশিখা" (১৯০৭), "ফুলের ফসল" (১৯১১), "কুহু ও কেকা" (১৯১২), "তুলির লিখন" (১৯১৪), "মনিমঞ্জুষা" (১৯১৫), "পুণ্যস্নান" (১৯১৯), এবং "সোনার তরী" (১৯২১)।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় নানাবিধ ছন্দোনির্মাণ ও ছন্দ উদ্ভাবনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বাংলা ভাষার নিজস্ব বাগধারা ও ধ্বনি সহযোগে নতুন ছন্দসৃষ্টি তাঁর কবিপ্রতিভার মৌলিক কীর্তি। এজন্য তিনি "ছন্দের জাদুকর" ও "ছন্দোরাজ" নামে সাধারণ্যে পরিচিত।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি মেথরদের মতো অস্পৃশ্য ও অবহেলিত সাধারণ মানুষ নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিদেশি কবিতার সফল অনুবাদকও ছিলেন। তিনি আরবি, ফারসি, চীনা, জাপানি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যএর বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি বিশ্বের কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ঘটান।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯২২ সালের ২৫ জুন কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি।

মন্তব্য করুন