স্বজনের শুভ্র হাড়

104
0

বুকের তিমির ঠেলে জেগে উঠেছে যে-দ্বীপ
সে-আমার ভালোবাসা,
ব্যথার প্রবাল জ’মে তিলে তিলে গ’ড়ে ওঠা বাসনার তুমি।

হননের রক্তপাত শেষে
বিনাশের ধংশযজ্ঞ শেষে
নীলিমার মতো শুভ্র স্নিগ্ধ তনু যে-দ্বীপ উঠেছে জেগে
সে-আমার রক্ত, মাংশ, হাড়, করোটির কষ্ট দিয়ে বোনা
একখানি স্বপ্ন-ধোয়া হৃদয়ের তাঁত।
সে-আমার নোতুন বসতভূমি সাগরের চর,
আমার গৃহের সুখ, জীবনের নিশ্চিত প্রহর।

এইখানে আবার সাজাবো নীড় সোনালি সময়,
এইখানে অঘ্রানের চাঁদ সমস্ত বছর দেবে নিভৃার পূর্নিমা-

বেদনার দীর্ঘ রাত্রি শেষে
বিনাশের রক্তপাত শেষে
আমাদের দ্যাখা হলো,
ব্যথার প্রবাল দ্বীপে পুনবায় দ্যাখ্য হলো তোমার আমার।
রক্তে ধোয় মমতার মাটি-
স্বজনের শুভ্র হাড় চারিপাশে ফুটে আছে অপরূপ উজ্জ্বল ফুল,
আমাদের সম্মুখে দিগন্তের মতো প্রসন্ন ভবিষ্যৎ…
ব্যথার প্রবাল দ্বীপে পুনরায় দ্যাখা হলো তোমার আমার।

রক্তের নিবিড় স্রোতে করাঘাত কোরে যায় স্মৃতি,
বুকের বা-পাশে কার অস্ফুট কান্নার মতো ব্যথা এসে বাজে!
স্বজনের রক্তে ধোয়া এই প্রিঢ মাটির সিঁথানে
আমাদের ব্যথিত প্রনাম এসো জ্বেলে দিই ধুপের মতোন।

কোনেদিন এই সব মানুষেরা ফিরবে না আর…
যে-রাখাল উদাস দুপুরে তার বাঁশির সুবাস ছড়াতো বাতাসে
সে আর ফিরবে না।
যে-নারী সিঁথায় লাল সিঁদুরের স্নিগ্ধ প্রেমে এঁকেছিলো মুগ্ধ নীড়
সে আর ফিরবে না।
যে-যুবক রাইফেলে ক্ষুদ্ধ হাত বারুদের মতো বিস্ফোরন
বুকে নিয়ে ছুটেছে মাতাল- সে আর ফিরবে না, সে আর ফিরবে না…

স্বজনের শুভ্র হাড় চারিপাশে ফুটে আছে ফুলের মতোন।
বিজয়ের ব্যথিত মিছিল তবু কেন চলে ভুলের ভুবনে
কেন তবু ভুল জীবনের পায়ে রেখে আসে পুষ্পের প্রনাম?

বুকে তিমির ভেঙে সুপ্রভাতে আমাদের দ্যাখা হয়েছিলো,
সুরম্য আলোর নিচে জেগে ওঠা আমাদের স্বপ্ন-ধোয়া দ্বীপ-
তবু সেই নিশ্চিত প্রহর আজো আসেনি এখানে,
তবু সেই অঘনের পূর্ন চাঁদ ছড়ায়নি জোস্নার আরক।

আমার ভাষার কণ্ঠ রোধ কোরে আছে আজো চতুর শ্বাপদ,
আজো শুধু স্বজনের শুভ্র হাড় চারিপাশে ফুটে আছে
উজ্জ্বল বিষন্ন ফুল।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন