মানুষের মানচিত্র ২২

135
0

তারপর সেই গল্প। সেই চেনা গল্প, চেনা কথা জীবনের-
মনে করো সেই মুখ খুঁজতে খুঁজতে আর কোথাও পাচ্ছো না,
সেই যে নদীর পাড়,দুটো লাশ পড়েছিল পাশাপাশি, পচা,
একজন তোমার গাঁয়ের ছেলে, অন্যজন সহোদর,ভাই…

অনেক খুঁজেও তুমি সেই চিহ্ন, সেই স্মৃতি কোথাও পাচ্ছো না।
সেই যে কিশোর খুব শান্ত, বোবা, নয় মাস সাথে সাথে ছিলো,
যুদ্ধে সে সমর্থ নয় তবু তাকে কোনোভাবে ফেরানো গেল না-
ভাবো, সেই ছেলে যুদ্ধে নয় মারা গেল স্বাধীন স্বদেশে তার।

সেই দুটো ঘন কৃষ্ণচূড়া,আমাদের শপথের স্মৃতিসাক্ষী,
মোড়লের লোহার কুড়োল তার কেটে নিছে জীবন-শিকড়।
মনে করো সেই মুখ, সেই প্রিয়মুখ খুঁজতে খুঁজতে আর-
আর কোথাও পাচ্ছো না খুঁজে চেনা মুখ, একটি যুদ্ধের মুখ।

উপরে তাকাও,দ্যাখো ওই মুখ চেনো তুমি,ওই যে মানুষ?
শকুনের মতো চোখ, ঠোঁটে রক্ত, কালো শুকনো জমাট রক্ত,
নোখে লেগে আছে দ্যাখো শিশুর মগজ-মাংশ,কুমারীর লজ্জা।
আর দ্যাখো একজন যুদ্ধের মানুষ কী বিমর্ষ, রুগ্ন, ম্লান—

সেই প্রিয় মুখ তুমি খুঁজতে খুঁজতে আর কোথাও পাচ্ছো না
সেই চেনা দেশ তুমি খুঁজতে খুঁজতে আর কোথাও পাচ্ছো না
সেই বাংলাদেশ তুমি খুঁজতে খুঁজতে আর কোথাও পাবে না
ত্রিশ লক্ষ লাশের উপরে ওই ছিন্নভিন্ন জাতির পতাকা॥

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন