মানুষের মানচিত্র ১৫

120
0

এতোকাল ধ’রে শুধু আকাশ মেঘলা হয় নামে না বাদল,
নাড়ি-ছেঁড়া ব্যথা ওঠে, কাতরায় খালি ঘরে চুড়ান্ত পোয়াতি।
পশ্চিমের মেঘ দেখে হাটবারে দোকানিরা গুটায় বেসাতি,
বরষা আসে না-শুধু মেঘ জ’মে ওঠে, বাজে মেঘের মাদল।

সময় গড়ায় আর ভাঙা ঘরে চলে রোজ মৃত্যুর মহড়া।
আমাদের স্বপ্নগুলো ক্রমশ ঝিমায়ে পড়ে বয়সের ভারে,
ভরা পূর্নিমায় কেউ আঙুল রাখে না আর দোতারার তারে,
ঘানির জোয়াল টানে একদার স্বপ্নবান প্রানবন্ত ঘোড়া।

বাওয়ালীর দুঃখ বোঝে বাদাবনে জোংড়াখুটা, জেলে ও মৌয়াল,
জনপদে তারা আর চেনে না নিজের মুখ। আলাদা মানুষ
তারা সব বিষের আগুনে পোড়া বিষমগ্ন মালশার তুষ,
পোড়ায় অন্যের ঘর, আর পোড়ে নিজে নিজে দগ্ধ চিরকাল।

আমরা দেখিনি আর পরষ্পর হাত খুলে গাঢ় কোনো সাঁঝে,
প্রতিটি হাতের তালু এক চিহ্ন ধ’রে আছে দেখি নাই কেউ।
পরষ্পর চেয়ে থেকে দেখি নাই সবার বুকেই এক ঢেউ,
সবার একই মুখ, সবার একই ভাষা চামড়ার ভাঁজে।

বড়শির সুতো ধরে অন্ধকারে বোসে থাকে রুগ্ন এক জেলে,
মাছের খোয়াব তার চোখের পিঁচুটি হয়ে ঢেকে রাখে চোখ।
বুকে তার ক্ষুধায় খরায় পোড়া দূরবর্তী স্বজনের শোক-
এক জেলে চায় যেন নিখিল ধোয়াতে তার নম্র স্বপ্ন ঢেলে॥

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন