মানুষের মানচিত্র ১২

ভরা বসন্তের দিনে এ-মধুর চাক তুমি ভেঙো না মৌয়াল,
মধুপোকা আসবে না, ভাঙা চাকে আসবে না রাঙা মউমাছি।
দারুন যক্ষের ধন আমি শুধু এইটুকু স্বপ্ন নিয়ে আছি।
ভেঙো না মধুর চাক, বিষ-পিঁপড়েয় তবে ছেয়ে যাবে ডাল-

রাতের শিয়াল আসে, ঝাঁক বেঁধে বানরেরা আসে অসময়,
অন্ধকার বাদাবনে পাতার আড়ালে রাখি লুকায়ে শরীর,
শরীর লুকোনো যায়, কী কোরে লোকোবো আমি সৌরভের তীর!
কী কোরে লুকোবো এই বসন্ত বাহার আমি তৃপ্ত তৃষ্ণাময়!

এমন চাঁদের রাতে চাকে হাত দিও নাকো রঙিলা নাগর,
তিষ্ণার গাঙেতে জল উথালি পাথালি করে সয় না পরানে।
অতো কি বোঝাও তুমি পূর্নিমার চাঁদ আর বসন্তের মানে?
বুঝি সব। জোয়ার এসেছে গাঙে খুলে যায় বুকের দুয়োর।

তুমি যদি কথা দাও আমারি কপালে দেবে সিন্দুরের টিপ,
বুক ভরা স্বপ্ন দেবে, আর দেবে জীবনের আধেক সীমানা,
দিঘির জলের মতো কালো এক শিশু দেবে তবে নেই মানা,
তুমি হয়ো ঘর আর আমি হবো অন্ধকারে ঘরের প্রদীপ।

যদি তুমি কথা দাও কার্তিকের অনটনে দেবে না তালাক,
তোমার বুকের নিচে আমি তবে ভূমি হবো, হবো এক নদী,
হৃদয়ের জল দিয়ে ভেজাবো তোমার কূল আমি নিরবধি-
তোমার জবান যদি সত্য হয় তবে তার বাসনা জ্বালাক॥

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন