বিমানবালা

ককপিটে রোদের নাগরদোলা দুলছে বিরামহীন,
প্রপেলারে মত্ত বিংশ শতক
যেন রকেন রোলে দোলে প্রিসলির স্বর।
উইন্ডোস্ক্রীনে মুখ রেখে চেয়ে থাকা বিদায়ের বিষন্ন মুখ—

এইবার উড়ে যাও, যাও পাখি পরবাসে যাও…

ওইখানে কেউ থাকে? মাখে তুষারের শিহরন বুকে ও মুখে?
ক্রিসেনথিমাম হাতে কেউ এসে দাঁড়াবে কি সুহাস,
উন্নত বাহুতে সম্ভাষন, নড়বে আঙুল তার সোনালীমা নোখ?

হয়তোবা ভ্রুর নীচে তার অনিদ্রা-হলুদ চোখে
আঁকাবাঁকা সাপের মতো শুয়ে থাকা নদী
পদ্মা, নীল, হোয়াংহো।
তোমার চোখেও কি নদী নয় ভীষন জমাট জল, বরফিত দীর্ঘশ্বাস?

বিশ্রামের রাতে নিসঙ্গ ক্লান্তিতে রানওয়ে যেমন
আঁধারের আলিঙ্গনে কাঁপে থরো থরো হিমেল ব্যথায়,
তেম্নি তোমারো চোখের খুব গভীরে এক বর্নহীন দাহ—
হৃদয়ের ক্ষতের মতো তুমি তাকে গোপনে লুকিয়ে রেখে
মুখে শুধু এঁকেছো এক সুদূরের অচেনা হাসি।

গন্ধহীন, স্পর্শহীন শাদা রাত পোড়ায় স্বদেশে,
বুকের ভেতরে জানি গর্জে ওঠে একলাখ ক্ষুধিত এঞ্জিন
একলাখ মত্ত প্রপেলার ঘোরে ওই মাথার ভেতরে।

তবু পৃথিবীতে রাত নামে নিবিড় তুষারের মতো,
তুমি শুধু উড়ে চলো ক্লান্তিহীন, তন্দ্রাহীন
অন্য এক সকালের দিকে।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
WRITTEN BY

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন