ক্লান্ত ইতিহাস

239
0

যে-পথে ফিরেছে সব, সেই পথে আমার হবে না ফেরা,
ভাঙনের রুগ্ন গান শুনতে শুনতে, বৃষ্টিতে আমুন্ডু ভিজে
বেহুলার ভাঙা ভেলা ফিরে যাবে জন্মের বিশ্বাসে!

সাথে আমি কী কী নেবো?
বিলাসী নগর থেকে তীক্ষ্ণ রমনীর প্রেম
মদ, মাংশ, কৃত্রিম হাসির ঠোঁট, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভালোবাসা?
আমি কী কী নেবো?
ইটের নিসর্গ থেকে জংধরা মানুষের শব, কালো টাকা,
জালিয়াতি, আলুর গুদাম আর এই ন-পুংশক রাজনীতি?

সেলফে বন্দি রবীন্দ্রনাথ, ড্রয়িংরুমে ঝুলে থাকা ধানশীষ
আহা বাংলাদেশ তুমি ঝুলে আছো- আমাদের সোনার বাংলা…
কতিপয় হিজড়া-পন্ডিত আর মূর্খ নেতাদের ডিনার টেবিলে
মুখ থুবড়ে প‘ড়ে আছে বিষন্ন বাংলাদেশ উচ্ছিষ্ট হাড়ের মতো।

আমি জানি এই ঋন আমাকেই শোধ দিতে হবে,
এই ধংশস্তুপ কাঁধে নিয়ে আমাকেই যেতে হবে সহস্র মাইল।

ফিরে যাবো।
যে-পথে সবাই ফেরে, হাসি খুশি মুখে গান, প্রিয়জন সাথে
সেই পথে আমার হবে না ফেরা, সেই পথ আমার হবে না-
রক্ত, ঘাম আর ধংশস্তুপ কাঁধে নিয়ে আমাকে ফিরতে হবে

ট্রেনের জানালা দিয়ে ধানক্ষেত দেখতে দেখতে আমার ফেরা হবে না।
চেঞ্জারে ভাটিয়ালি, লালন শুনতে শুনতে আমার ফেরা হবে না,
বুক ভরা ভালোবাসা মৌন মুগ্ধ গান আমার হবে না ফেরা-

আমাকে ফিরতে হবে ঘাম, রক্ত আর সময়ের ধংশস্তুপ কাঁধে
শেষতম সৈনিকের মতো একা একা ক্লান্ত ইতিহাস।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন