স্বপ্নগুলো

172
0

আমাদের স্বপ্নগুলো
এইভাবে ঠুকরে ঠুকরে খাবে কাক ও শকুন।
আমাদের আকাংখারা
মুখ থুবড়ে পড়বে জমকালো পিচের রাস্তায়।
একাকি বান্ধবহীন আমাদের হৃদপিন্ড জুড়ে ধংশস্তুপ
জ’মে উঠতে থাকবে ব্যাংকে সঞ্চিত টাকার মতো।

আমাদের চরমপন্থি ফুসফুসের জন্যে প্রয়োজন
আজ একটু নির্মল বাতাসের ছোঁয়া,
প্রয়োজন এক টুকরো সজীব ভালোবাসা।
আমাদের সন্ত্রস্ত, সশস্ত্র মস্তিষ্কের জন্যে প্রয়োজন
সামান্য আশ্রয়,
অমলিন, একটু স্নেহের টোকা।

না আমাদের স্বপ্নকে, না সংবিধানকে
আমরা কিছুই, কাউকেই বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না।
আমরা ধ’রে রাখতে পারছি না আমাদের
সময়ের বেগবান স্রোতগুলো,
স্বপ্নবান প্রাণবন্ত আত্মাগুলো—
কবরের সুবিশাল নির্জনতা আজ নেমে এসেছে এখানে,
এই গ্রহে।

আমাদের স্বপ্নগুলো অপ্রচলিত পথে ছুটতে চায়,
তাই রক্তাক্ত তার পা,
আঘাতে বিক্ষত দেহ,
তবু সে ছুটছে—
প্রতারনাহীন আমাদের বিশ্বাসের বিক্ষুব্ধ আগুন,
অন্ধকার পোড়াতে পারেনি বোলে আজ
নিজেই সে নিজেকে পোড়ায়।

প্রলোভনহীন ভালোবাসা আমাদের
প্রতিবার রক্তাক্ত হচ্ছে বিত্তের বিনাশী চাকায়।
আমাদের রক্তস্রোতে প্রবাহিত হচ্ছে
পল্যুটেড পৃথিবীর ক্ষমাহীন বিষ।

এ্যালকোহল ঝাঁপিয়ে পড়ছে যকৃতে,
নিরন্ন পাকস্থলিতে।
নিকোটিনে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে
রক্ত প্রবাহিনী নালীগুলো।
আমাদের স্বপ্নময় আন্দোলনগুলো
বারবার বুটে ও বুলেটে, আপোসে ও ষড়যন্ত্রে
ঝিমিয়ে পড়ছে।

শাদা একটি গোলাপ আমাদের অন্তর্গত স্বপ্ন,
সমতার এক নীল আকাশের স্বপ্ন আমাদের,
আমাদের স্বপ্ন শ্রমময় একটি দিনের,
সম্মিলিত নৃত্য আর গানে উন্মাতাল
একটি সন্ধ্যার স্বপ্ন আমাদের,
আমাদের স্বপ্ন এক প্রশান্ত নিদ্রার রাত—
অথচ কোথাও তার কনামাত্র ছায়া নেই, চিহ্ন নেই,
স্বপ্নের সূচনা নেই এখনো কোথাও।
আমাদের স্বপ্নগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে কাক ও শকুন।

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন