মানুষের মানচিত্র ৬

163
0

কুটুম এসেছে ঘরে, সাঁচিপান সাজো বউ রুপোর বাটায়।
চিরে মুড়ি আছে কিছু? নয়তো বাতাসা দাও সাথে নারকেল।
একেবারে খালি মুখ, আর কি সেদিন আছে, আহারে আকাল!
শ্রাবনের বানের নাহান ভেসে গেছে সব-হায়রে সুদিন।

কি সুখে ছিলাম বউ! ভাত মাছ, তরকারি কিসের অভাব?
অতিত্তি বাড়িতে এসে খালি মুখে ফিরে যাবে সে কেমন কথা!
আর কি সেদিন আছে- কতো রাজা বদলায়, দিন তো ফেরে না।
কিছুই মেলে না আর, কেতাবের কলিকাল এরে বুঝি কয়?

ও বউ মাদুর দাও, ছায়ায় বসুক এসে, বাইরে যা খরা-
ছেলেরা সবাই মাঠে, পুকুরে যে জাল ফ্যালে তা-ও কেউ নেই।
দুপুর গড়ায়ে এলো- ও বউ রান্না চড়াও, চাল দাও বেশি,
আর কি সেদিন আছে! কিছুই মেলে না আর, কিছুই মেলে না।

ঝুড়ি ভরা ফলমূল, দুই বেলা দুধ আহা কী শারান্ত গাই,
খাটাশ আটার রুটি কোনদিন ছুঁয়ে কি দেখেছি, কোনদিন?
কতো রাজা বদলায়, দিন বদলের কথা শোনায় ছেলেরা,
দিন তো ফেরে না বউ? বানের জলের মতো ভেসে যায় সব…

পশরের পাড়ে আজো এই দৃশ্য বেঁচে আছে, দৃশ্যের মানুষ।
সব গেছে, আছে শুধু আহলাদটুকু, আছে অতীতের স্মৃতি।
এইসব প্রবীনেরা হারানো দিনের গন্ধ ধ’রে রাখে আজো,
আজো তার স্বাদ পায়, আজো তার স্বাদ চায় বিলাতে অন্যকে॥

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
লিখেছেন

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ – ২১ জুন ১৯৯১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, এবং রাজনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ ওয়ালিউল্লাহ ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং মা শিরিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। তিনি বাগেরহাটের মংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭৩ সালে ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৭০-এর দশকে সাহিত্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "উপদ্রুত উপকূল" ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি "ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম", "মানুষের মানচিত্র", "মৌলিক মুখোশ", "বিষ বিরিক্ষের বীজ", "ছোবল", "রুদ্রসমগ্র", "শ্রেষ্ঠ কবিতা"সহ আরও বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে।

শহিদুল্লাহ কবিতা ছাড়াও গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতায়ও সমানভাবে সফল ছিলেন। তার গল্পের মধ্যে "অনির্বাণ", "হীরামন", "অগ্নিগর্ভ", "হাজার বছরের নীরবতা", ও "সীমানা প্রাচীর" উল্লেখযোগ্য। তার নাটকের মধ্যে "একজন সৈনিকের চিঠি", "একজন বীর সন্তান", "সোনালি কাঁকড়ার দেশে", ও "লাল গম্বুজ" উল্লেখযোগ্য। তার গানগুলি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।

শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের সেই দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে তারা বিবাহবিচ্ছেদ করেন।

শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবি হিসেবে গণ্য করা হয়।

শহিদুল্লাহর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার কবিতা, গল্প, নাটক, গান, ও সাংবাদিকতা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সমৃদ্ধি এনেছে। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা, প্রেম, প্রকৃতি, ও মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন