নারী ও প্রেম

25
0

জানি জানি হে দেবতা নারীর অন্তর কুঞ্জে
যেদিন তোমার পুষ্প জাগে
মর্মের মলয় তার বিপুল সুরভী কুঞ্জে
আনে বহি মুগ্ধ অনুরাগে।

সে সৌরভ রসে নারী আপনার হারায় নিত্য
বিস্মরয় দোষ গুণ ভেদ
মন মনি মঞ্জুষার পরশ মানিক বিত্ত
তৃপ্ত রাখে শর্বতর খেদ।

সুধীরা পাষাণে গড়া লৌহ দার মর্মপুরে
নিঃশব্দে অর্গল যায় ছুটি
কঠিন প্রাচীর শ্রেণী মৃদুল সোহিনী সুরে
পুষ্পসম পড়ে টুটি টুটি
সেদিন স্বেচ্ছায় নারী সর্বাঙ্গে অধীনতা
চিত্তের আনন্দরাগে দীপ্ত হয়ে সে দিনতা
রানী গৌরব করে দান।

কার লাগি সর্বযুগে সর্ব দেশে কালে নারী
স্নিগ্ধ স্নেহে চির ত্যাগশীলা
পুরুষ পুরুষ মর্মে সিঞ্চিয়া অমৃত বারি
রচে মর্তে অমর্তের লীলা।

আপনারে রিক্ত করে নিঃশেষে করিয়া দান
কেন তার উদ্বেলিত সুখ
সংযমে সেবায় পুণ্যে ক্ষমাই সুন্দর প্রাণ
কি লাগিয়া বিমুগ্ধ উৎসুক।

কে তারে শিখাইল বল মৌন অভিমান লীলা
হাসি অশ্রু ইন্দ্র ধনু জালে
কভু দীপ্ত জ্যোতির্ময়ী কখনো সরলশীলা আরক্ত গোলাপ রাগ গালে।

রহস্য অতল চোখে বিচিত্র চাহনি তীর
অধরে বিচিত্রতর হাসি
কে তারে অজেয়া করি দিল নেত্রে অশ্রুনীর
অমোঘ আয়ুধ রাশি রাশি।

মোর বসন্তের পুষ্প কোন বসন্তের এক
পরিণাম রমণীয় সাঁঝে
সুন্দর মাল্যের রূপে সার্থ
কতা লভিবেক
দুলিয়া ও কম কণ্ঠ মাঝে।

শিহরি উঠিবে চম্পা-বকুল ব্যাকুল চিতে
নিঃশ্বসিবে সুরভি-নিঃশ্বাস
শুক্লা হবে দুখ রাত্রি রজনীগন্ধার গীতে
আছে চিত্তে পরম বিশ্বাস।

হে নিত্য, হে চিররম্য, সুচির নবীন বন্ধু
হে শাশ্বত, সুন্দর পরম
আজিকে তোমার বংশী আমার হৃদয় রন্ধ্রে
তুলেছে তরঙ্গ মনোরম।

আজিকে তোমার বার্তা অপরাজিতার কুঞ্জে
ফুটায়েছে জয় নীল ফুল
অরণ্য-লক্ষ্মীর বক্ষে মালা শোভে পুঞ্জে পুঞ্জে
কর্ণে দোলে সৌরভের দুল।

আবর্তিত ঋতুচক্রে বসন্ত ধরায় নামি
লীলা নৃত্য করে ক্ষণকাল
আমার অন্তরপুরে তুমি জানো অন্তর্যামি
তারি চির মহোৎসব জাল।

উৎসব অঙ্গন পথে যারা নিত্য আসে যায়
আমি খুঁজি তাহাদেরি মাঝ
কোথায় রয়েছ তুমি কার মৌন আঁখিচ্ছায়ে
হে আমার রাজ-অধিরাজ!

শুধু যে তোমারি লাগি যুগে যুগে চিরদিন
রচি নীড় মর্ম মধু দিয়া
নিরুদ্দেশ পথ যাত্রী পান্থ যত লক্ষ্যহীন
যেথায় বিশ্রাম লভে গিয়া।

সবার হৃদয় তলে আমি খুঁজি সত্তা কার
হে নারীর চির অন্বেষিয়
তোমা লাগি রচি নীড়, গাহি গীত, গাথি হার
ওগো প্রেম! আত্মার আত্মীয়।

রাধারাণী দেবী
লিখেছেন

রাধারাণী দেবী

রাধারাণী দেবী বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি। ভাষার মাধুর্যে ভাবের স্নিগ্ধতায় আর ছন্দের সাবলীল দক্ষতায় 'অপরাজিতা দেবী' ছদ্মনামে সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মহিলা কবি।

রাধারাণী দেবী ১৩ নভেম্বর, ১৯০৩ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী ও মাতা ছিলেন গৃহিণী। রাধারাণী দেবীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাড়িতে। পরে তিনি কলকাতার বেথুন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

রাধারাণী দেবীর লেখা প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে 'মানসী' পত্রিকায়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অপরাজিতা' প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* 'সুন্দর ও ভালোবাসা' (১৯২৬)
* 'হৃদয়ের কথা' (১৯২৯)
* 'প্রকৃতির কথা' (১৯৩২)
* 'সত্য ও সুন্দর' (১৯৩৫)
* 'জীবন ও মৃত্যু' (১৯৪২)
* 'অঞ্জলি' (১৯৪৭)
* 'আলো ও অন্ধকার' (১৯৫০)
* 'মন ও জীবন' (১৯৫২)

রাধারাণী দেবীর কবিতাগুলির মধ্যে প্রেম, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, মানবতাবাদ ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। তার কবিতাগুলির ভাষা ও ছন্দ অত্যন্ত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর। তিনি বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এক অনন্য স্থান দখল করে আছেন।

রাধারাণী দেবীর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯৬৪ সালে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৭৩ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার এবং ১৯৮২ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

রাধারাণী দেবী ১৯৮৯ সালের ৩০ নভেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য জগত এক অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

রাধারাণী দেবীর কবিতার কিছু বিখ্যাত লাইন:

* "প্রিয়তম, আমি তোমার অপেক্ষায় বসে আছি,
* যেন প্রদীপের শিখায় বসে থাকে মশা।"
* "আমার ভালোবাসা তোমার জন্য,
* আমার গান তোমার জন্য।"
* "হে প্রকৃতি, তুমি আমার মা,
* তোমার কোলে আমি সুখী।"
* "হে দেশ, তোমার জন্য আমার জীবন,
* তোমার জন্য আমার মৃত্যু।"

রাধারাণী দেবীর কবিতাগুলি আজও পাঠকদের মন ছুঁয়ে যায়। তার কবিতাগুলি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

মন্তব্য করুন