আকাশের চাঁদ

162
0

হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —
এই হল তার বুলি।
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া,
কাঁদে সে দু হাত তুলি।
হাসিছে আকাশ, বহিছে বাতাস,
পাখিরা গাহিছে সুখে।
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে,
বিকালে ঘরের মুখে।
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
খেলিছে আঙিনা-কোণে,
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
হাসিছে আপন মনে।
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
চলেছে যে যার কাজে —
কত জনরব কত কলরব
উঠিছে আকাশমাঝে।
পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,
‘কে তুমি কাঁদিছ বসি । ‘
সে কেবল বলে নয়নের জলে,
‘হাতে পাই নাই শশী।’

সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে
অযাচিত ফুলদল,
দখিন সমীর বুলায় ললাটে
দক্ষিণ করতল।
প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
করিছে তাহার দেহে,
রজনী তাহারে বুকের আঁচলে
ঢাকিছে নীরব স্নেহে।
কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর
কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি,
পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে
লইতে বন্ধু করি।
এই পথে গৃহে কত আনাগোনা,
কত ভালোবাসাবাসি,
সংসারসুখ কাছে কাছে তার
কত আসে যায় ভাসি,
মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া,
কহে সে নয়নজলে,
‘তোমাদের আমি চাহি না কারেও,
শশী চাই করতলে।’

শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল,
সেও ব’সে এক ঠাঁই।
অবশেষে যবে জীবনের দিন
আর বেশি বাকি নাই,
এমন সময়ে সহসা কী ভাবি
চাহিল সে মুখ ফিরে
দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
সুনীল সিন্ধুতীরে।
সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
কাটিতেছে পাকা ধান,
ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায়,
মাঝি বসে গায় গান।
দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর,
বধূরা চলেছে ঘাটে,
মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন
আসিছে গ্রামের হাটে।
নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি,
কহে ম্রিয়মাণ মন,
‘শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই
আর বার এ জীবন।’

দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
সুন্দর লোকালয়
প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে
চির-কল্লোলময়।
স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
ফিরিছে গৃহের মাঝে,
প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর
প্রতি দিবসের কাজে।
সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে
ঘরের ছেলের মতো,
রজনী সবারে কোলেতে লইছে
নয়ন করিয়া নত।
ছোটো ছোটো ফুল, ছোটো ছোটো হাসি,
ছোটো কথা, ছোটো সুখ,
প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি,
ছোটো ছোটো হাসিমুখ
আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
মানবজীবন ঘিরি,
বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
দেখিতেছে ফিরি ফিরি।

দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম
অতীত জীবন-রেখা,
অস্তরবির সোনার কিরণে
নূতন বরনে লেখা।
যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া
চাহে নি কখনো ফিরে,
নবীন আভায় দেখা দেয় তারা
স্মৃতিসাগরের তীরে।
হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
পুরবীরাগিণী বাজে,
দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়
ওই জীবনের মাঝে।
দিনের আলোক মিলায়ে আসিল
তবু পিছে চেয়ে রহে—
যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়
তার বেশি কিছু নহে।
সোনার জীবন রহিল পড়িয়া
কোথা সে চলিল ভেসে।
শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
রবিশশীহীন দেশে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লিখেছেন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তিনি ছিলেন একজন বহুব্যাক্তিত্ব, যার কর্মের প্রতিফলন ঘটেছে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, সমাজকর্ম ও রাজনীতিতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ঠাকুর পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু ও লেখক। তার মাতা সারদা দেবী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ গৃহবধূ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শৈশব থেকেই সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন এবং সংগীত শিখতেন। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং তিনি রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গীতের তালিম দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের ইংরেজি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি সেখানে বেশিদিন পড়াশোনা করেননি। ১৮৮০ সালে তিনি কলেজে ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই পড়াশোনা চালিয়ে যান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের চার মেয়ে এবং এক ছেলে ছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮২ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সোনারতরী" প্রকাশ করেন। এরপর তিনি আরও অনেক কাব্যগ্রন্থ, কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও চিত্রকর্ম রচনা করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাগুলির মধ্যে "গীতাঞ্জলি", "চিত্রাঙ্গদা", "চোখের জল", "শেষের কবিতা", "ঘরে বাইরে", "নৌকাডুবি", "শেষের রাত্রি" ও "পথের পাঁচালী" উল্লেখযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি এটি প্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় এবং এশীয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক। তার রচনাগুলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

মন্তব্য করুন