অনন্ত জীবন

29
0

অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ,
জনমেছি দু দিনের তরে–
যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে
গান গাই আনন্দের ভরে।
এ আমার গানগুলি দু দণ্ডের গান
রবে না রবে না চিরদিন–
পুরব-আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস,
পশ্চিমেতে হইবে বিলীন।

তোরা ফুল, তোরা পাখি, তোরা খোলা প্রাণ,
জগতের আনন্দ যে তোরা,
জগতের বিষাদ-পাসরা।
পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী
তোরা তার একেকটি ঢেউ,
কখন উঠিলি আর কখন মিলালি
জানিতেও পারিল না কেউ।

নাই তোর নাই রে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা
ভেসে আসে, সাগরে মিশায়–
জান না কোথায় তারা যায়!
একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর
রচিছে বিশাল মহাদেশ,
না জানি কবে তা হবে শেষ!
মুহূর্তেই ভেসে যায় আমাদের গান,
জান না তো কোথায় তা যায়!
আকাশের সাগরসীমায়!
আকাশ-সমুদ্র-তলে গোপনে গোপনে
গীতরাজ্য হতেছে সৃজন,
যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে
সেইখানে করিছে গমন।
আকাশ পুরিয়া যাবে শেষ,
উঠিবে গানের মহাদেশ।

নাই তোর নাই রে ভাবনা,
এ জগতে কিছুই মরে না।
কাল দেখেছিনু পথে হরষে খেলিতেছিল
দুটি ভাই গলাগলি করি
দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল
দুটি সখা হাতে হাতে ধরি,
দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে
ঘুমায়ে করিছে স্তনপান,
ঘুমন্ত মুখের ‘পরে বরষিছে স্নেহধারা
স্নেহমাখা নত দু’নয়ান,
দেখেছিনু রাজপথে চলেছে বালক এক
বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি–
কত কী যে দেখেছিনু, হয়তো সে-সব ছবি
আজ আমি গিয়েছি পাসরি।
তা বলে নাহি কি তাহা মনে?
ছবিগুলি মেশেনি জীবনে?
স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি
রচিতেছে জীবন আমার–
কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে
চিনিতে পারি নে তাহা আর।
হয়তো অনেকদিন দেখেছিনু ছবি এক
দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে–
তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি
সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে।
হয়তো অনেক দিন শুনেছিনু পাখি এক
আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি,
সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি
প্রাণ মন উঠিছে উথুলি।
সকলি মিশেছে আসি হেথা,
জীবনে কিছু না যায় ফেলা–
এই-যে যা-কিছু চেয়ে দেখি
এ নহে কেবলি ছেলেখেলা।

এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে
নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি,
চারি দিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম
জীবনের স্রোত মিশে আসি।
সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা,
কোটি কোটি তারা হতে ঝরে,
জগতের যত হাসি যত গান যত প্রাণ
ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে–
মেশে আসি সেই সিন্ধু-’পরে।
পৃথ্বী হতে মহাস্রোত ছুটিতেছে অবিরাম
সেই মহাসাগর-উদ্দেশে,
আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি
অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে–
সাগরে পড়িব অবশেষে।
জগতের মাঝখানে সেই সাগরের তলে
রচিত হতেছে পলে পলে
অনন্ত-জীবন মহাদেশ,
কে জানে হবে কি তাহা শেষ!

তাই বলি, প্রাণ ওরে, গান গা পাখির মতো,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি–
তুই যাবি, গান যাবে, একসাথে ভেসে যাবে
তুই আর তোর গানগুলি।
মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্তসাগরতলে,
একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ,
তুই আর তোর এই গান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লিখেছেন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তিনি ছিলেন একজন বহুব্যাক্তিত্ব, যার কর্মের প্রতিফলন ঘটেছে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, সমাজকর্ম ও রাজনীতিতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ঠাকুর পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু ও লেখক। তার মাতা সারদা দেবী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ গৃহবধূ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শৈশব থেকেই সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন এবং সংগীত শিখতেন। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং তিনি রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গীতের তালিম দিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের ইংরেজি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি সেখানে বেশিদিন পড়াশোনা করেননি। ১৮৮০ সালে তিনি কলেজে ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই পড়াশোনা চালিয়ে যান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের চার মেয়ে এবং এক ছেলে ছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮২ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সোনারতরী" প্রকাশ করেন। এরপর তিনি আরও অনেক কাব্যগ্রন্থ, কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও চিত্রকর্ম রচনা করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাগুলির মধ্যে "গীতাঞ্জলি", "চিত্রাঙ্গদা", "চোখের জল", "শেষের কবিতা", "ঘরে বাইরে", "নৌকাডুবি", "শেষের রাত্রি" ও "পথের পাঁচালী" উল্লেখযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি এটি প্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় এবং এশীয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক। তার রচনাগুলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

মন্তব্য করুন