সুধীরে নিশার আঁধার ভেদিয়া
ফুটিল প্রভাততারা।
হেথা হোথা হতে পাখিরা গাহিল
ঢালিয়া সুধার ধারা।
মৃদুল প্রভাতসমীর পরশে
কমল নয়ন খুলিল হরষে,
হিমালয় শিরে অমল আভায়
শোভিল ধবল তুষারজটা।
খুলি গেল ধীরে পূরবদ্বার,
ঝরিল কনককিরণধার,
শিখরে শিখরে জ্বলিয়া উঠিল,
রবির বিমল কিরণছটা।
গিরিগ্রাম আজি কিসের তরে,
উঠেছে নাচিয়া হরষভরে,
অচল গিরিও হয়েছে যেমন
অধীর পাগল-পারা।
তটিনী চলেছে নাচিয়া ছুটিয়া,
কলরব উঠে আকাশে ফুটিয়া ,
ঝর ঝর ঝর করিয়া ধ্বনি
ঝরিছে নিঝরধারা।
তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া মালা,
চলিয়াছে গিরিবাসিনী বালা,
অধর ভরিয়া সুখের হাসিতে
মাতিয়া সুখের গানে।
মুখে একটিও নাহিকো বাণী
শবদচকিতা মেনকারানী
তৃষিত নয়নে আকুল হৃদয়ে,
চাহিয়া পথের পানে।
আজ মেনকার আদরিণী উমা
আসিবে বরষ-পরে।
তাইতে আজিকে হরষের ধ্বনি
উঠিয়াছে ঘরে ঘরে।
অধীর হৃদয়ে রানী আসে যায়,
কভু বা প্রাসাদশিখরে দাঁড়ায়,
কভু বসে ওঠে, বাহিরেতে ছোটে
এখনো উমা মা এলনা কেন?
হাসি হাসি মুখে পুরবাসীগণে
অধীরে হাসিয়া ভূধরভবনে,
“কই উমা কই’ বলে “উমা কই’,
তিলেক বেয়াজ সহে না যেন!
বরষের পরে আসিবেন উমা
রানীর নয়নতারা ,
ছেলেবেলাকার সহচরী যত
হরষে পাগল-পারা।
ভাবিছে সকলে আজিকে উমায়
দেখিবে নয়ন ভ’রে,
আজিকে আবার সাজাব তাহায়
বালিকা উমাটি ক’রে।
তেমনি মৃণালবলয়-যুগলে,
তেমনি চিকন-চিকন বাকলে,
তেমনি করিয়া পরাব গলায়
বনফুল তুলি গাঁথিয়া মালা।
তেমনি করিয়া পরায়ে বেশ
তেমনি করিয়া এলায়ে কেশ,
জননীর কাছে বলিব গিয়ে
“এই নে মা তোর তাপসী বালা’।
লাজ-হাসি-মাখা মেয়ের মুখ
হেরি উথলিবে মায়ের সুখ,
হরষে জননী নয়নের জলে
চুমিবে উমার সে মুখখানি।
হরষে ভূধর অধীর-পারা
হরষে ছুটিবে তটিনীধারা,
হরষে নিঝর উঠিবে উছসি,
উঠিবে উছসি মেনকারানী।
কোথা তবে তোরা পুরবাসী মেয়ে
যেথা যে আছিস আয় তোরা ধেয়ে
বনে বনে বনে ফিরিবি বালা,
তুলিবি কুসুম, গাঁথিবি মালা,
পরাবি উমার বিনোদ গলে।
তারকা-খচিত গগন-মাঝে
শারদ চাঁদিমা যেমন সাজে
তেমনি শারদা অবনী শশী
শোভিবে কেমন অবনীতলে!
ওই বুঝি উমা, ওই বুঝি আসে,
দেখো চেয়ে গিরিরানী!
আলুলিত কেশ, এলোথেলো বেশ,
হাসি-হাসি মুখখানি।
বালিকারা সব আসিল ছুটিয়া
দাঁড়াল উমারে ঘিরি।
শিথিল চিকুরে অমল মালিকা
পরাইয়া দিল ধীরি।
হাসিয়া হাসিয়া কহিল সবাই
উমার চিবুক ধ’রে,
“বলি গো স্বজনী, বিদেশে বিজনে
আছিলি কেমন করে?
আমরা তো সখি সারাটি বরষ
রহিয়াছি পথ চেয়ে —
কবে আসিবেক আমাদের সেই
মেনকারানীর মেয়ে!
এই নে, সজনী, ফুলের ভূষণ
এই নে, মৃণাল বালা,
হাসিমুখখানি কেমন সাজিবে
পরিলে কুসুম-মালা।’
কেহ বা কহিল,”এবার স্বজনি,
দিব না তোমায় ছেড়ে
ভিখারি ভবের সর্বস্ব ধন
আমরা লইব কেড়ে।
বলো তো স্বজনী, এ কেমন ধারা
এয়েছ বরষ-পরে,
কেমনে নিদিয়া রহিবে কেবল
তিনটি দিনের তরে।’
কেহ বা কহিল,”বলো দেখি,সখী,
মনে পড়ে ছেলেবেলা?
সকলে মিলিয়া এ গিরিভবনে
কত-না করেছি খেলা!
সেই মনে পড়ে যেদিন স্বজনী
গেলে তপোবন-মাঝে–
নয়নের জলে আমরা সকলে
সাজানু তাপসী-সাজে।
কোমল শরীরে বাকল পরিয়া
এলায়ে নিবিড় কেশ
লভিবারে পতি মনের মতন
কত-না সহিলে ক্লেশ।
ছেলেবেলাকার সখীদের সব
এখনো তো মনে আছে,
ভয় হয় বড়ো পতির সোহাগে
ভুলিস তাদের পাছে!’
কত কী কহিয়া হরষে বিষাদে
চলিল আলয়-মুখে,
কাঁদিয়া বালিকা পড়িল ঝাঁপায়ে
আকুল মায়ের বুকে।
হাসিয়া কাঁদিয়া কহিল রানী,
চুমিয়া উমার অধরখানি,
“আয় মা জননি আয় মা কোলে,
আজ বরষের পরে।
দুখিনী মাতার নয়নের জল
তুই যদি, মা গো, না মুছাবি বল্
তবে উমা আর ,কে আছে আমার
এ শূন্য আঁধার ঘরে?
সারাটি বরষ যে দুখে গিয়াছে
কী হবে শুনে সে ব্যথা,
বল্ দেখি, উমা, পতির ঘরের
সকল কুশল-কথা।’
এত বলি রানী হরষে আদরে
উমারে কোলেতে লয়ে,
হরষের ধারা বরষি নয়নে
পশিল গিরি-আলয়ে।
আজিকে গিরির প্রাসাদে কুটিরে
উঠিল হরষ-ধ্বনি,
কত দিন পরে মেনকা-মহিষী
পেয়েছে নয়নমণি!
লিখেছেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ঠাকুর পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু ও লেখক। তার মাতা সারদা দেবী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ গৃহবধূ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শৈশব থেকেই সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন এবং সংগীত শিখতেন। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং তিনি রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গীতের তালিম দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের ইংরেজি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি সেখানে বেশিদিন পড়াশোনা করেননি। ১৮৮০ সালে তিনি কলেজে ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই পড়াশোনা চালিয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের চার মেয়ে এবং এক ছেলে ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮২ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সোনারতরী" প্রকাশ করেন। এরপর তিনি আরও অনেক কাব্যগ্রন্থ, কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও চিত্রকর্ম রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাগুলির মধ্যে "গীতাঞ্জলি", "চিত্রাঙ্গদা", "চোখের জল", "শেষের কবিতা", "ঘরে বাইরে", "নৌকাডুবি", "শেষের রাত্রি" ও "পথের পাঁচালী" উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি এটি প্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় এবং এশীয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক। তার রচনাগুলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তিনি ছিলেন একজন বহুব্যাক্তিত্ব, যার কর্মের প্রতিফলন ঘটেছে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, দর্শন, সমাজকর্ম ও রাজনীতিতে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ঠাকুর পরিবারের সন্তান। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু ও লেখক। তার মাতা সারদা দেবী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ গৃহবধূ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শৈশব থেকেই সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন এবং সংগীত শিখতেন। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং তিনি রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গীতের তালিম দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের ইংরেজি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি সেখানে বেশিদিন পড়াশোনা করেননি। ১৮৮০ সালে তিনি কলেজে ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই পড়াশোনা চালিয়ে যান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের চার মেয়ে এবং এক ছেলে ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮২ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সোনারতরী" প্রকাশ করেন। এরপর তিনি আরও অনেক কাব্যগ্রন্থ, কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও চিত্রকর্ম রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাগুলির মধ্যে "গীতাঞ্জলি", "চিত্রাঙ্গদা", "চোখের জল", "শেষের কবিতা", "ঘরে বাইরে", "নৌকাডুবি", "শেষের রাত্রি" ও "পথের পাঁচালী" উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি এটি প্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় এবং এশীয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক। তার রচনাগুলি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।