স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো

20
0

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’

এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না৷
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হদৃয় মাঠখানি?

জানি, সেদিনের সব স্মৃতি ,মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত৷ তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ … ৷

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প৷
সেই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর৷
না পার্ক না ফুলের বাগান, — এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়৷
আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে৷

কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক৷
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মত শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে৷
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্যে কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: “কখন আসবে কবি?’ “কখন আসবে কবি?’

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হদৃয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের৷

নির্মলেন্দু গুণ
লিখেছেন

নির্মলেন্দু গুণ

নির্মলেন্দু গুণ, একজন বাংলাদেশী কবি, গীতিকার, সাংবাদিক এবং চিত্রশিল্পী। তিনি ১৯৪৫ সালের ২১ জুন নেত্রকোনার বারহাট্টায় জন্মগ্রহণ করেন।

গুণ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সাংবাদিকতায় তার কর্মজীবন শুরু করেন এবং দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা পত্রিকায় কাজ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখেন।

গুণ একজন প্রতিভাবান কবি এবং তার কবিতা বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। তার কবিতায় নারীপ্রেম, শ্রেণীসংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধিতা প্রভৃতি বিষয়বস্তু প্রাধান্য পায়। তার উল্লেখযোগ্য কবিতার মধ্যে রয়েছে “হুলিয়া”, “মানুষ”, “আফ্রিকার প্রেমের কবিতা”, “একটি অসমাপ্ত কবিতা” ইত্যাদি।

গুণ একজন জনপ্রিয় গীতিকারও। তিনি অনেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গান রচনা করেছেন। তার রচিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে “ওরে সোনা রোদ্দুর”, “ওরে নীল দরিয়া”, “আমি তোমার প্রেমে বলব না” ইত্যাদি।

গুণ তার সাহিত্যকর্মের জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ গীতিকার) লাভ করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

গুণ একজন সমাজসেবক ব্যক্তিও। তিনি অনেক সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। তিনি বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছেন।

মন্তব্য করুন