১৪০০ সাল

138
0

[কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আজি হতে শতবর্ষ পরে” পড়িয়া]

আজি হ’তে শত বর্ষ আগে!
কে কবি, স্মরণ তুমি ক’রেছিলে আমাদেরে শত আনুরাগে,
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে।

ধেয়ানী গো, রহস্য-দুলাল!
উতারি’ ঘোমটাখানি তোমার আঁখির আগে
কবে এল সুদূর আড়াল?

আনাগত আমাদের দখিন-দূয়ারী
বাতায়ন খুলি তুমি, হে গোপন হে স্বপ্ন-চারী,
এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে,
শত বর্ষ পরে যেথা তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি রাতে।
নেহারিলে বেদনা-উজ্জ্বল আঁখি-নীরে,
আনমনা প্রজাপতি নীরব পাখায়
উদাসীন, গেলে ধীরে ফিরে।

আজি মোরা শত বর্ষ পরে
যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে ।।
জড়িত জাগর ঘুমে শিথিল শয়নে
শুনিতেছি প্রিয়া মোর তোমার ইঙ্গিত গান সজল নয়নে।

আজো হায়
বারে বারে খুলে যায়
দক্ষিণের রুদ্ধ বাতায়ন,
গুমরি গুমরি কাঁদে উচাটন বসন্ত-পবন
মনে মনে বনে বনে পল্লব মর্মরে,
কবরীর অশ্রুজল বেশী-খসা ফুল-দল পড়ে ঝ’রে ঝ’রে!

ঝিরি ঝিরি কাঁপে কালো নয়ন-পল্লব,
মধুপের মুখ হতে কাড়িয়া মধুপী পিয়ে পরাগ আসব!
কপোতের চষ্ণুপুটে কপোতীর হারায় কূজন
পরিয়াছে বনবধূ যৌবন-আরক্তিম কিংশুক-বসন।
রহিয়া রহিয়া আজো ধরনীর হিয়া
সমীর উচ্ছ্বাস্ব যেন উঠে নিঃশ্বসিয়া!

তোমা হ’তে শত বর্ষ পরে–
তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি,
হে কবীন্দ্র, অনুরাগ ভরে!
আজি এই মদালসা ফাগুন-নিশীথে
তোমার ইঙ্গিত জাগে তোমার সঙ্গীতে!
চতুরালি, ধরিয়াছি তোমার চাতুরী।
করি’ চুরি

আসিয়াছ আমাদের দুরন্ত যৌবনে,
কাব্য হ’য়ে, গান হ’য়ে, সিক্তকন্ঠে রঙ্গীলা স্বপনে।
আজিকার যত ফুল- বিহঙ্গের যত গান যত রক্ত-রাগ
তব অনুরাগ হ’তে হে চির-কিশোর কবি,
আনিয়াছে ভাগ !
আজি নব-বসন্তের প্রভাত-বেলায়
গান হ’য়ে মাতিয়াছে আমাদের যৌবন-মেলায়।

আনন্দ দুলাল ওগো হে চির অমর।
তরুণ তরুণি মোরা জাগিতেছি আজ তব মাধবী বাসর।
যত গান গাহিয়াছ ফুল-ফোটা রাতে–
সবগুলি তার
একবার–তা’ পর আবার
প্রিয়া গাহে, আমি গাহি, আমি গাহি প্রিয়া গাহে সাথে।
গান-শেষে অর্ধরাতে স্বপনেতে শুনি
কাঁদে প্রিয়া, “ওগো কবি ওগো বন্ধু ওগো মোর গুণী–”
স্বপ্ন যায় থামি’,
দেখি, বন্ধু, আসিয়াছ প্রিয়ার নয়ন-পাতে অশ্রু হ’য়ে নামি’।
মনে লাগে, শত বর্ষ আগে
তুমি জাগো–তব সাথে আরো কেহ জাগে
দূরে কোন্ ঝিলিমিলি-তলে
লুলিত-অঞ্চলে।
তোমার ইঙ্গিতখানি সঙ্গীতের করুণ পাখায়
উড়ে যেতে যেতে সেই বাতায়নে ক্ষণিক তাকায়,
ছুঁয়ে যায় আখি-জল রেখা,
নুয়ে যায় অলক-কুসুম,
তারপর যায় হারাইয়া,–তুমি একা বসিয়া নিঝ্‌ঝুম।
সে কাহার আঁখিনীর- শিশির লাগিয়া,
মুকুলিকা বাণী তব কোনটি বা ওঠে মঞ্জুরিয়া,
কোনটি বা তখনো গুঞ্জরি ফেরে মনে
গোপনে স্বপনে।

সহসা খুলিয়া গেল দ্বার,
আজিকার বসন্ত প্রভাতখানি দাঁড়াল করিয়া নমস্কার।
শতবর্ষ আগেকার তোমারি সে বাসন্তিকা দূতি
আজি তব নবীনের জানায় আকুতি!…
হে কবি-শাহান-শাহ। তোমারে দেখিনি মোরা,
সৃজিয়াছ যে তাজমহল-
শ্বেতচন্দনের ফোঁটা কালের কপালে ঝলমল–
বিস্ময়-বিমুগ্ধ মোরা তাই হেরি,
যৌবনেরে অভিশাপি– “কেন তুই শতবর্ষ করিলি রে দেরী?”
হায়, মোরা আজ
মোম্‌তাজে দেখিনি, শুধু দেখিতেছি তাজ!

শতবর্ষ পরে আজি হে কবি-সম্রাট!
এসেছে নূতন কবি–করিতেছে তব নান্দীপাঠ!
উদয়াস্ত জুড়ি’ আজো তব
কত না বন্দনা-ঋক ধ্বনিছে নব নব।
তোমারি সে হারা-সুরখানি
নববেণু-কুঞ্জে-ছায়ে বিকশিয়া তোলে নব বাণী।

আজি তব বরে
শতবেণু-বীণা বাজে আমাদের ঘরে।
তবুও পুরে না হিয়া ভরে না ক’ প্রাণ,
শতবর্ষ সাঁতরিয়া ভেসে আসে স্বপ্নে তব গান।
মনে হয়, কবি ,
আজো আছ অস্তপাট আলো করি’ আমাদেরি রবি!
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে
যে অভিবাদন তুমি ক’রেছিলে নবীনেরে রাঙা অনুরাগে,
সে-অভিবাদনখানি আজি ফিরে চলে
প্রণামী-কমল হ’য়ে তব পদতলে!

মনে হয়, আসিয়াছ অপূর্ণের রূপে
ওগো পূর্ণ আমাদেরি মাঝে চুপে চুপে।
আজি এই অপূর্ণের কম্প্র কন্ঠস্বরে
তোমারি বসন্তগান গাহি তব বসন্ত-বাসরে–
তোমা হ’তে শতবর্ষ পরে!

কাজী নজরুল ইসলাম
লিখেছেন

কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬) ছিলেন একজন বাঙালি কবি, লেখক, সুরকার, গীতিকার, সংগীতজ্ঞ, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী, স্বদেশী সৈনিক এবং দার্শনিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তার পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন একজন মুসলিম ধর্মপ্রচারক এবং মাতা জাহেদা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী।

কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাজীবন শুরু হয় স্থানীয় একটি মসজিদের মক্তবে। ১৯১০ সালে তিনি চুরুলিয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৪ সালে তিনি স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে বর্ধমানের থানা স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯১৬ সালে তিনি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯১৭ সালে। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল "বিদ্রোহী"। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল:

* অগ্নিবীণা
* ভাঙার গান
* ফণীমনসা
* চক্রবাক
* গীতিগুচ্ছ
* সঞ্চিতা
* বিষের বাঁশি
* রেখা
* চিরঞ্জীবী

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাগুলিতে তিনি বিদ্রোহ, প্রেম, দেশপ্রেম, মানবতাবাদ, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার ইত্যাদি বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন। তার কবিতাগুলিতে তিনি অত্যন্ত সহজ ও সরল ভাষায় আবেগপ্রবণভাবে বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলাম একজন সফল গীতিকারও ছিলেন। তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় গান রচনা করেছেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গানগুলি হল:

* "আমার সোনার বাংলা"
* "চলো চলো আমরা সবাই মিলে"
* "ওরে বন্ধুরে"
* "প্রলয়শিখা"
* "ধনধান্য পুষ্পভরা"
* "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো"
* "আমার সোনার বাংলায়"
* "মহাবিদ্রোহের প্রথম সূর্য"

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।

কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৭৬), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন।

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্য করুন