হেমন্তের রাতে

269
1
হেমন্তের রাতে

শীতের ঘুমের থেকে এখন বিদায় নিয়ে বাহিরের অন্ধকার রাতে
হেমন্তলক্ষ্মীর সব শেষ অনিকেত অবছায়া তারাদের
সমাবেশ থেকে চোখ নামায়ে একটি পাখির ঘুম কাছে
পাখিনীর বুকে ডুবে আছে,–
চেয়ে দেখি;– তাদের উপরে এই অবিরল কালো পৃথিবীর
আলো আর ছায়া খেলে–মৃত্যু আর প্রেম আর নীড়।
এ ছাড়া অধিক কোনো নিশ্চয়তা নির্জন্তা জীবনের পথে
আমাদের মানবীয় ইতিহাস চেতনায়ও নেই;– (তবু আছে।)
এমনই অঘ্রাণ রাতে মনে পড়ে–কত সব ধূসর বাড়ির
আমলকীপল্লবের ফাঁক দিয়ে নক্ষত্রের ভিড়
পৃথিবীর তীরে–তীরে ধূসরিম মহিলার নিকটে সন্নত
দাঁড়ায়ে রয়েছে কত মানবের বাষ্পাকুল প্রতীকের মতো–
দেখা যেত; এক আধ মহূর্ত শুধু;– সে অভিনিবেশ ভেঙ্গে ফেলে
সময়ের সমুদ্রের রক্ত ঘ্রাণ পাওয়া গেল;– ভীতিশব্দ রীতিশব্দ মুক্তিশব্দ এসে
আরো ঢের পটভূমিকার দিকে দিগন্তের ক্রমে
মানবকে ডেকে নিয়ে চ’লে গেল প্রেমিকের মতো সসম্ভ্রমে;
তবুও সে প্রেম নয়, সুধা নয়,– মানুষের ক্লান্ত অন্তহীন
ইতিহাস–আকুতির প্রবীণতা ক্রমায়াত ক’রে সে বিলীন?

আজ এই শতাব্দীতে সকলেরি জীবনের হৈমন্ত সৈকতে
বালির উপরে ভেসে আমাদের চিন্তা কাজ সংকল্পের তরঙ্গকঙ্কাল
দ্বীপসমুদ্রের মতো অস্পষ্ট বিলাপ ক’রে তোমাকে আমাকে
অন্তহীন দ্বীপহীনতার দিকে অন্ধকারে ডাকে।
কেবলি কল্লোল আলো–জ্ঞান প্রম পূর্ণত্র মানবহৃদয়
সনাতন মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে– তবু– ঊনিশ শো অনন্তের জয়

হয় যেতে পারে, নারি, আমাদের শতাব্দীর দীর্ঘতর চেতনার কাছে
আমরা সজ্ঞান হয়ে বেঁচে থেকে বড়ো সময়ের
সাগরের কূলে ফিরে আমাদের পৃথিবীকে যদি
প্রিয়তর মনে করি প্রিয়তম মৃত্যু অবধি;–
সকল আলোর কাজ বিষণ্ন জেনেও তবু কাজ ক’রে– গানে
গেয়ে লোকসাধারণ ক’রে দিতে পারি যদি আলোকের মানে।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন

একটি চিন্তা “হেমন্তের রাতে

  1. শীতের ঘুমের থেকে/ এখন বিদায় নিয়ে/ বাহিরের অন্ধকার রাতে/=৮,৮,৮
    হেমন্তলক্ষ্মীর সব /শেষ অনিকেত /অবছায়া তারাদের/৮,৬,৮
    সমাবেশ থেকে চোখ/ নামায়ে একটি/ পাখির ঘুম কাছে/৮,৬,৮
    পাখিনীর বুকে ডুবে আছে,–/৮
    কবি , অক্ষরবৃত্তের ছন্দের ব্যবহার , কবিতার ভিতরে এক রকম আধুনিকতা সৃষ্টি করছেন, তার কবিতা আমার কাছে পড়লে বেশ লাগে।