রাত্রি, মন, মানবপৃথিবী

90
0

এ অন্ধকার জলের মতো; এই পৃথিবীর সকল কিণার ঘিরে
নরক নগর তাপী পাপীর শান্ত শুশ্রুষায়
কোথার থেকে এসে কোথায় লক্ষ্যে চ’লে যায়;
সকল উত্তেজনায় আসে স্নিগ্ধ শরীরে

কে ব্যাহত পাখির মতো প্রাণাকাশে ওড়ার পথে সময়শায়কে
কারা কোথায় আলোককণার মতন, সূর্য হতে
জন্ম পেয়েই হারিয়ে গেছে অন্ধ রক্ত স্রোতে;
বু্দ্ধিজীবী নষ্ট হলো কোথায় মনের গোলকধাঁধার ছকে-

সবের কাছে নিরাভিমান রাত্রি এসে নমিত হ’লে বলে;
কথা ভাবায়; কথা ভাবার সর্বনাশে শান্তি কোথায় আছে?
তবুও এসে অনেক কাজের পরে অন্তরাশ্রয়িতার কাছে;
মৃত্যু ঘুমের অতীত ব্যথা ক্ষয় পাবে কি সহজ সরলে?

এখানে কোনো আকাশসারী ইন্দ্রজাল নেই;
এখানে কালের সিঁড়ির পরে মধ্যপথে অগম সিঁড়ির দিকে
তাকিয়ে বিষয় ভেবে নিতে হয়েছে নতুন যানের প্রতীকে;
মৃত্যু নেই, মায়া নেই, ইতিহাস অমোঘ তবু ঠিক এ-কারণেই

ক্লান্তি নেই; মনেনদীর দু-পার ঘিরে ছাউনি পড়েছে
এপারে এরা জীবনপ্রেমিক: ঘোষণা ক’রে বলে;
ওপারে এরা এই পৃথিবীর নিষ্পেষিত নরনারীর দলে,
সিদ্ধি চায়: গণনাহীন মৃত্যুসেনা হাজির করেছে

অনেক বিনাশ সাঙ্গ হ’লে অন্ধকারের নতুন জাতক, ঢল
তবুও অনেক প্রাণের প্রয়াস ঝরনা প্রেম সহিষ্ণুতা আলো
দেখেছে আবার নবনবীন নৈরাশ্যে হারালো:
নাবিক ক্লান্ত : নদী কি নিষ্ফল?

অন্ধকারের হৃদয় এখন নিজের কাছে থেমে
আশা আলো হারিয়ে যতোই শ্লেষ পরিহাস শক্তিতে কঠিন
হ’য়ে সন্ততিদের কাছে পিতৃলোকের ঋণ
আঁধার জলাঞ্জলি ভাবে- ততোই জনমানব প্রেমে

নিহিত হ’য়ে নতুন জলকণিকারাশি বানিয়ে নিতে চায়।
আবার কি তা রক্তকণা হ’য়ে গেলো? স্ফালন ক’রে অন্ধকারে জ্ঞানী
হ’য়ে সে দেখছে ইতিহাসের বিরাট হয়রানি
নবীন বীজের মতন আজো মানবতার বিবর্ণ আত্মায়।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন