রাত্রি (আলোপৃথিবী)

101
0

অইখানে কিছু আগে- বিরাট প্রাসাদে- এক কোণে
জ্ব’লে যেতেছিল ধীরে এক্‌সটেন্‌শন্‌ লেকচারের আলো।
এখন দেয়ালে রাত- তেমন ততটা কিছু নয়;
পথে পথে গ্যাসলাইট র’য়েছে ঝাঁঝালো
এখনো সূর্যের তেজ উপসংহারের মত জেগে।
এখনো টঙ্গে চ’ড়ে উপরের শেলফের থেকে
বই কি বিবর্ণ কীট- ধুলো- মাকড়সা বার হবে
দোকানের সেলস্‌ম্যান চুপে ভেবে দেখে।
এখনো নামেনি সেই নির্জন রিকশগুলো- নিয়ন্তার মত,
সমূহ ভীড়ের চাপে র’য়েছে হারায়ে।
অজস্র গলির পথে একটি মানুষ
যুগপৎ র’য়েছে দাঁড়ায়ে;
পৃথিবীর সকলের হৃদয়ের প্রতীকের মত;
এই রাত থেকে আরো অধিক গভীরতর রাতে
কলুটোলা- পাথুরিয়াঘাটা- মির্জাপুরে
এসপ্লানেডের ফুটপাতে
মালাঙ্গা লেনের পথে- ক্রিক রো’তে
ককবার্ন লেনের ভিতরে
এক জোড়া শিঙ যদি দেখা দেয় লোকটার টাকে-
পরচুলা চুরি ক’রে নিয়ে গেছে তবে যাদুকর।
এখানে রাত্রির পারে তোমার নিকট থেকে আমি
চ’লে গেলে
চ’লে যাব;-
পৃথিবীর কাছ থেকে নয়;
রাত্রি এই সারারাত জীবনের সকল বিষয়
হয়ে আছে।
তিত্তিরাজ গাছ থেকে শিশির নীরবে
ঝরে যায়;
ডানার আঘাতে যায় কাকদম্পতীর;
হলুদ খড়ের পরে ঝ’রে পড়ে আবার শিশির
হাওয়ার গুঁড়ির মত।
কোথায় হারায়ে তুমি গিয়েছ কখন।
মাথার উপরে সব নক্ষত্রেরা ছুরির মত বিচক্ষণ
সময়ের সূতো কেটে- অবিরাম সময়ের সূতো কেটে ফেলে
আমার চোখের পরে রাত্রির প্রাঞ্জলতা ঢেলে;
কোথাও বাতাবী উষ্ণ হয়ে ওঠে- ঘুরে যায় মাকরসাপোকার লাটিম,
ভাঁড় হাসে,- সম্রাজ্ঞীর অবয়ব হয়ে থাকে হিম;
নদীরা শিশুর মত- শিশুরা নদীর মত দূর;
স্বর্গের কিনারে গিয়ে ভিড় আর ভিখিরির নীল আলো করে টিমটিম।
শিশুর কপাল থেকে বেজে ওঠে নরকের বিচিত্র ডিন্ডিম।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন