মিশর

110
0

‘মমী’র দেহ বালুর তিমির জাদুর ঘরে লীন-
‘স্ফীঙ্ক্‌স-দানবীর অরাল ঠোঁটের আলাপ আজি চুপ!
ঝাঁ ঝাঁ মরুর ‘লু’য়ের ফুঁয়ে হচ্চে বিলীন-ক্ষীণ
মিশর দেশের কাফন্‌ পাহাড়-পিরামিতের স্তুপ!

নিভে গেছে ঈশিশের রই বেদীর থেকে ধূমা,
জুড়িয়ে গেছে লক্‌লকে সেই রক্তজিভার চুমা!
এদ্দিনেতে ফুরিয়ে গেছে কুমিরপূজার ঘটা,
দুলছে মরুমশান শিরে মহাকালের জটা!
ঘুমন্তদের কানে কানে কয় সে-ঘুমা ঘুমা!

ঘুমিয়ে গেছে বালুর তলে ফ্যারাও, ফ্যারাওছেলে-
তাদের বুকে যাচ্চে আকাশ বর্শা ঠেলে ঠেলে!
হাওয়ার সেতার দেয় ফুঁপিয়ে মেম্ননেরই বুক,
ডুবে গেছে মিশররবি-বিরাট বেলের ভুখ
জিহ্বা দিয়ে জঠর দিয়ে গেছে তোমার জ্বেলে!

পিরাপিডের পাশাপাশি লালচে বালুর কাছে
স্থবির মরণ-ঘুমের ঘোরে মিশর শুয়ে আছে!
সোনার কাঠি নেই কি তাহার? জাগবে না কি আর!
মৃত্যু সে কি শেষের কথা? শেষ কি শবাধার?
সবাই কি গো ঢালাই হবে চিতার কালির ছাঁচে!

নীলার ঘোলা জলের দোলায় লাফায় কালো সাপ।
কুমিরগুলোর খুলির খিলান, করাত দাঁতের খাপ
উর্ধ্বমুখে রৌদ্র পোহায়; ঘুমপাড়ানির ঘুম
হানছে আঘাত-আকাশ বাতাস হচ্ছে যেন গুম্‌!
ঘুমের থেকে উপচে পড়ে মৃতের মনস্তাপ!

নীলা নীলা- ধুক্‌ধুকিয়ে মিশরকবর পারে
রইলে জেগে বোবা বুকের বিকল হাহাকারে
লাল আলেয়ার খেয়া ভাসায় রামেসেসের দেশ!
অতীত অভিশাপের নিশা এলিয়ে এলোকেশ
নিভিয়ে দেছে দেউটি তোমার দেউল-কিনারে!

কলসি কোলে নীলনদেতে যেতেছে ঐ নারী
ঐ পথেতে চলতে আছে নিগ্রো সারি সারি
ইয়াঙ্কী ঐ ঐ য়ুরোপী-চীনে-তাতার মুর
তোমার বুকের পাঁজর দ’লে টলতেছে হুড়মুড়্‌-
ফেনিয়ে তুলে খুন্‌খারাবি, খেলাপ, খবরদারি!

দিনের আলো ঝিমিয়ে গেল-আকাশে ঐ চাঁদ!
চপল হাওয়ায় কাঁকন নীলনদেরই বাঁধ!
মিশর ছুঁড়ি গাইছে মিঠা শুড়িখানার সুরে
বালুর খাতে, প্রিয়ের সাথে- খেজুরবনে দূরে!
আফ্রিকা এই, এই যে মিশর-জাদুর এ যে ফাঁদ!

ওয়েসিসের ঠান্ডা ছায়ায় চৈতি চাঁদের তলে
মিশরবালার বাঁশির গলা কিসের কথা বলে!
চলছে বালুর চড়াই ভেঙে উটের পরে উট-
এই যে মিশর-আফ্রিকার এই কুহকপাখাপুট!
কী এক মোহ এই হাওয়াতে- এই দরিয়ার জলে!

শীতল পিরামিডের মাথা-গীজের মুরতি
অঙ্কবিহীন যুগসমাধির মূক মমতা মথি
আবার যেন তাকায় অদূর উদয়গিরির পানে!
মেম্নেনের ঐ কন্ঠ ভরে চারণ-বীনার গানে!
আবার জাগে ঝান্ডাঝালর- জ্যান্ত আলোর জ্যোতি!

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন