এই নিদ্রা

85
0

আমার জীবনে কোনো ঘুম নাই
মৎস্যনারীদের মাঝে সবচেয়ে রূপসী সে নাকি
এই নিদ্রা?

গায় তার ক্ষান্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ- অবসাদ সুখ
চিন্তার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন-বিমুখ
প্রাণ তার

এই দিন এই রাত্রি আসে যায়- বুঝিতে দেয় না তারে; কোনো ধ্বনি ঘ্রাণ
কোনো ক্ষুধা- কোনো ইচ্ছা- পরীরো সোনার চুল হয় যাতে ম্লানঃ
আমাদের পৃথিবীর পরীদের;- জানেনা সে; শোনেনা সে
জীবনের লক্ষ্য মৃত নিঃশ্বাসের স্বর;
তাহলে ঘুমাত কবে; সে শুধু সুন্দর,
প্রশ্নহীন অভিজ্ঞতাহীন দূর নক্ষত্রের মতো
সুন্দর অমর শুধু; দেবতারা করেনি বিক্ষত
ইহাদের।

এদের অপার রূপ শান্তি সচ্ছলতা
তবুও জানিত যদি আমার এ-জীবনের মুহূর্তের কথা
মানুষের জীবনের মুহূর্তের কথা।

দেবতারা করেনি বিক্ষত ইহাদেরঃ
(দেবতারা করেনি বিক্ষত নিজেদের
কোনো অভিজ্ঞতা নাই দেবতার)
ঘুঘুদের শাদা ডানা- নীল রাত্রি- কমলরঙের মেঘ- সমুদ্রের ফেনা রোদ-
হরিণের বুকে বেদনার
নীরব আঘাত;
এরা প্রশ্ন করেনাকোঃ ইহারা সুন্দর শান্ত- জীবনের উদ্‌যাপনে সন্দেহের হাত
ইহারা তোলে না কেউ আঁধারে আকাশে
ইহাদের দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই- চোখে ঘুম আসে।
শুনেছে কে ইহাদের মুখে কোনো অন্ধকার কথা?
সকল সংকল্প চিন্তা রক্ত আনে ব্যথা আনে- মানুষের জীবনের এই বীভৎসা
ইহাদের ছোঁয় নাকো;-
ব্যুবনিক প্লেগের মতন
সকল আচ্ছন্ন শান্ত স্নিগ্ধতারে নষ্ট ক’রে ফেলিতেছে মানুষের মন!

গোলাপী ধূসর মেঘে পশ্চিমের বিয়োগ সে দ্যাখে না কি?
প্রজাপতি পাখি-মেয়ে করেনা কি মানুষের জীবনের ব্যথা আহরণ?
তবু এরা ব্যথা নয়ঃ ইহারা আবৃত সব- বিচিত্র- নীরব
অবিরল জাদুঘর এরা এক;- এরা রূপ ঘুম শান্তি স্থির
এই মৃত পাখি কীট- প্রজাপতি রাঙা মেঘ- সাপের আঁধার মুখে
ফরিঙের জোনাকির নীড়
এইসব।
আমি জানি, একদিন আমিও এমন
পতঙ্গের হৃদয়ের ব্যথা হব- সমুদ্রের ফেনা শাদা ফেনায় যেমন
ভেঙে পড়ে- ব্যথা পায়।
মানুষের মন
তবুও রক্তাক্ত হয় কেন এক অন্য বেদনায়
কীট যাহা জানে নাকো- জানে নাকো নদী ফেনা ঘাসরোদ- শিশির কুয়াশা
জ্যোৎস্নাঃ আম্লান হেলিওট্রোপ হায়!
এ-সৃষ্টির জাদুঘরে রূপ তারা- শান্তি- ছবি- তাহারা ঘুমায়
সৃষ্টি তাই চায়।

ভুলে যাব যেই সাধ- যে-সাহস এনেছিলো মানুষ কেবল
যাহা শুধু গ্লানি হলো- কৃপা হলো- নক্ষত্রের ঘৃণা হলো-
অন্য কোনো স্থল
পেল নাকো।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন