সেদিন এ-ধরণীর

40
0

সেদিন এ-ধরণীর
সবুজ দ্বীপের ছায়া—উতরোল তরঙ্গের ভিড়
মোর চোখে জেগে-জেগে ধীরে-ধীরে হ’লো অপহত
কুয়াশায় ঝ’রে পড়া আতসের মতো।
দিকে-দিকে ডুবে গেল কোলাহল,
সহসা উজানজলে ভাটা গেল ভাসি,
অতিদূর আকাশের মুখখানা আসি
বুকে মোর তুলে গেল যেন হাহাকার।

সেইদিন মোর অভিসার
মৃত্তিকার শূন্য পেয়ালার ব্যথা একাকারে ভেঙে
বকের পাখার মতো শাদা লঘু মেঘে
ভেসেছিলো আতুর উদাসী;
বনের ছায়ার নিচে ভাসে কার ভিজে চোখ
কাঁদে কার বাঁরোয়ার বাঁশি
সেদিন শুনিনি তাহা;
ক্ষুধাতুর দুটি আঁখি তুলে
অতিদূর তারকার কামনায় আঁখি মোর দিয়েছিনু খুলে।

আমার এ শিরা-উপশিরা
চকিতে ছিঁড়িয়া গেল ধরণীর নাড়ীর বন্ধন,
শুনেছিনু কান পেতে জননীর স্থবির ক্রন্দন—
মোর তরে পিছু ডাক মাটি-মা—তোমার;
ডেকেছিলো ভিজে ঘাস—হেমন্তের হিম মাস—জোনাকির ঝাড়,
আমারে ডাকিয়াছিলো আলেয়ার লাল মাঠ—শ্মশানের খেয়াঘাট আসি,
কঙ্কালের রাশি,
দাউ-দাউ চিতা,
কতো পূর্ব জাতকের পিতামহ পিতা,
সর্বনাশ ব্যসন বাসনা,
কতো মৃত গোক্ষুরার ফণা,
কতো তিথি—কতো যে অতিথি—
কতো শত যোনিচক্রস্মৃতি
করেছিলো উতলা আমারে।
আধো আলো—আধেক আঁধারে
মোর সাথে মোর পিছে এলো তা’রা ছুটে,
মাটির বাটের চুমো শিহরি উঠিল মোর ঠোঁটে, রোমপুটে;
ধুধু মাঠ—ধানখেত—কাশফুল—বুনো হাঁস—বালুকার চর
বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া;

মাঝপথে থেমে গেল তা’রা সব;
শকুনের মতো শূন্যে পাখা বিথারিয়া
দূরে—দূরে—আরো দূরে—আরো দূরে চলিলাম উড়ে,
নিঃসহায় মানুষের শিশু একা—অনন্তের শুক্ল অন্তঃপুরে
অসীমের আঁচলের তলে
স্ফীত সমুদ্রের মতো আনন্দের আর্ত কোলাহলে
উঠিলাম উথলিয়া দুরন্ত সৈকতে—
দূর ছায়াপথে।
পৃথিবীর প্রেতচোখ বুঝি
সহসা উঠিল ভাসি তারকাদর্পণে মোর অপহৃত আননের প্রতিবিম্ব খুঁজি;
ভ্রূণভ্রষ্ট সন্তানের তরে
মাটি-মা ছুটিয়া এলো বুকফাটা মিনতির ভরে;
সঙ্গে নিয়ে বোবা শিশু—বৃদ্ধ মৃত পিতা,
সূতিকা-আলয় আর শ্মশানের চিতা,
মোর পাশে দাঁড়ালো সে গর্ভিণীর ক্ষোভে;
মোর দুটি শিশু আঁখি-তারকার লোভে
কাঁদিয়া উঠিল তার পীনস্তন—জননীর প্রাণ;
জরায়ুর ডিম্বে তার জন্মিয়াছে যে ঈপ্সিত বাঞ্ছিত সন্তান
তার তরে কালে-কালে পেতেছে সে শৈবালবিছানা শালতমালের ছায়া,
এনেছে সে নব-নব ঋতুরাগ—পউষনিশির শেষে ফাগুনের ফাগুয়ার মায়া;
তার তরে বৈতরণীতীরে সে যে ঢালিয়াছে গঙ্গার গাগরী,
মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার ভিজে রসে উঠিয়াছে ভরি,
উঠিয়াছে দূর্বাধানে শোভি,
মানবের তরে সে যে এনেছে মানবী;
মশলাদরাজ এই মাটিটার ঝাঁঝ যে রে—
কেন তবে দু-দণ্ডের অশ্রু অমানিশা
দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!
নয়ন মুদিনু ধীরে—শেষ আলো নিভে গেল পলাতক নীলিমার পারে,
সদ্য-প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন