১৯৪৬-৪৭

155
1

দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা:
পথে-ঘাটে ট্রাক ট্রামলাইনে ফুটপাতে;
কোথাও পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে— মনে হয়,
জলের মতন দামে।
সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছুবে
সকলের আগে সকলেই তাই।

অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়, তবু
নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব— অথবা যা নিলেমের নয়
সে-সব জিনিস
বহুকে বঞ্চিত ক’রে দু-জন কি একজন কিনে নিতে পারে।
পৃথিবীতে সুদ খাটে: সকলের জন্যে নয়।
অনির্বচনীয় হুণ্ডি একজন দু-জনের হাতে।
পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে
সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।
বাকি সব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন
কোথাও নদীর পানে উড়ে যেতে চায়,
অথবা মাটির দিকে— পৃথিবীর কোনো পুনঃপ্রবাহের বীজের ভিতরে
মিশে গিয়ে। পৃথিবীতে ঢের জন্ম নষ্ট হ’য়ে গেছে জেনে, তবু
আবার সূর্যের গন্ধে ফিরে এসে ধুলো ঘাস কুসুমের অমৃতত্বে কবে
পরিচিত জল, আলো আধো অধিকারিণীকে অধিকার ক’রে নিতে হবে
ভেবে তা’রা অন্ধকারে লীন হ’য়ে যায়।

লীন হ’য়ে গেলে তা’রা তখন তো— মৃত।
মৃতেরা এ-পৃথিবীতে ফেরে না কখনো।
মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?
কোনো-কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের
হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতের কোথাও নেই বলে মনে হয়;

তা হ’লে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে
কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হ’তো।

বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।
সূর্য অস্তে চ’লে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার
খোঁপা বেঁধে নিতে আসে— কিন্তু কার হাতে?
আলুলায়িত হ’য়ে চেয়ে থাকে— কিন্তু কার তরে?
হাত নেই— কোথাও মানুষ নেই; বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন
আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী
হ’তে পেরেছিলো প্রায়; নিভে গেছে সব।

এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;
নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক
এ-পাড়ার বড়ো মেজো…ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের
ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত;
এখন টুঁ শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও;
মানুষের হাড় খুলি মানুষের গণনার সংখ্যাধীন নয়;
সময়ের হাতে অন্তহীন।

ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হ’তো
ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি বাগ্‌দির
ঈশ্বরী মেয়ের সাথে
বিবাহের কিছু আগে— বিবাহের কিছু পরে— সন্তানের জন্মাবার আগে।
সে-সব সন্তান আজ এ-যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ়
ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা প’ড়ে
মৃত প্রায়; আজকের এই সব গ্রাম্য সন্ততির
প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে— অন্ধকারে জমিদারদের
চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে।
ওরা খুব বেশি ভালো ছিলো না; তবুও
আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষরতায়

অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে
পৃথক আর-এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিলো।

আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো ক’রে কথা ভাবা এখন কঠিন;
অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার
নিয়ম এখন আছে; তারপর একা অন্ধকারে
বাকি সত্য আঁচ ক’রে নেওয়ার রেওয়াজ
র’য়ে গেছে; সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে।

সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়— দ্বেষ।
সৃষ্টির মনের কথা: আমাদেরি আন্তরিকতাতে
আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা
খুঁজে আনা। প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল
ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে
দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল
হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়;
মানুষ মেরেছি আমি— তার রক্তে আমার শরীর
ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
বধ ক’রে ঘুমাতেছি— তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে
মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী
সকলকে আলো দেবে মনে ক’রে অগ্রসর হ’য়ে
তবুও কোথাও কোনো আলো নেই ব’লে ঘুমাতেছে।

ঘুমাতেছে।
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—

আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে সুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এণ্টালীর—’
কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে;
সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে
এই সব প্রাণকণা জেগেছিলো— বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে
সহসা সুন্দর ব’লে মনে হয়েছিলো কোনো উজ্জ্বল চোখের
মনীষী লোকের কাছে এই সব অনুর মতন
উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে।
সূর্যের আলোর ঢলে রোমাঞ্চিত রেণুর শরীরে
রেণুর সংঘর্ষে যেই শব্দ জেগে ওঠে
সেখানে সময় তার অনুপম কণ্ঠের সংগীতে
কথা বলে; কাকে বলে? ইয়াসিন মকবুল শশী
সহসা নিকটে এসে কোনো-কিছু বলবার আগে
আধ খণ্ড অনন্তের অন্তরের থেকে যেন ঢের
কথা বলে গিয়েছিলো; তবু—
অনন্ত তো খণ্ড নয়; তাই সেই স্বপ্ন, কাজ, কথা
অখণ্ড অনন্তে অন্তৰ্হিত হ’য়ে গেছে;
কেউ নেই, কিছু নেই— সূর্য নিভে গেছে।

এ-যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে, তবে।
আমরা এ-পৃথিবীর বহুদিনকার
কথা কাজ ব্যথা ভুল সংকল্প চিন্তার
মর্যাদায় গড় কাহিনীর মূল্য নিংড়ে এখন
সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপম বাচনের রীতি।
মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো
না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল;

জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।
অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু
আমাদের এই শতকের
বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু— বেড়ে যায় শুধু;
তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই ব’লে অর্থময়
জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।

এ-যুগে কোথাও কোনো আলো— কোনো কান্তিময় আলো
চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের; নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার
রাত্রির মায়ের মতো: মানুষের বিহ্বল দেহের
সব দোষ প্রক্ষালিত ক’রে দেয়— মানুষের বিহ্বল আত্মাকে
লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল ক’রে
তাকে আর সুধায় না— অতীতের সুধানো প্রশ্নের
উত্তর চায় না আর— শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন
অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ
বীতকাম হয় যাতে— এ-জীবন ধীরে-ধীরে বীতশোক হয়,
স্নিগ্ধতা হৃদয়ে জাগে; যেন দিকচিহ্নময় সমুদ্রের পারে
কয়েকটি দেবদারুগাছের ভিতরে অবলীন
বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ কাছে আসে— মানুষের রক্তাক্ত আত্মায়
সে-হাওয়া অনবচ্ছিন্ন সুগমের— মানুষের জীবন নির্মল।
আজ এই পৃথিবীতে এমন মহানুভব ব্যাপ্ত অন্ধকার
নেই আর? সুবাতাস গভীরতা পবিত্রতা নেই?
তবুও মানুষ অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে
অন্ধকার হ’তে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে
যে অনবনমনে চলেছে আজো— তার হৃদয়ের
ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক’রে চেতনার
বলয়ের নিজ গুণ র’য়ে গেছে ব’লে মনে হয়।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন

একটি চিন্তা “১৯৪৬-৪৭