হঠাৎ তোমার সাথে

106
0

হঠাৎ তোমার সাথে কলকাতাতে সে এক সন্ধ্যায়
উনিশশো চুয়াল্লিশে দেখা হ’ল- কত লোক যায়
তড়াম বাস ট্যাক্সি মোটর জিপ হেঁকে
যাদের হৃদয়ে বেশি কথা হাতে কাজ কম-
তাদের অনেকে পায়ে হেঁটে চলে যায়।

কেবলি ক্লান্তিতে ধুঁকে আমাদের মুখে ঠোঁটে তবু যেই হাসি
ফুটে উঠে স্বপ্নকে খণ্ডন ক’রে বিষয়প্রত্যাশী
অমূল্য সংসারী সে-ই-বাজারে বন্দরে ঘোরে, মাপজোক করে
হিসেবের খতিয়ানে লাভ হলে রক্তের ভিতরে
তৃপ্তি পায়-লোকসান হয়ে গেলে অন্ধকারে নিগৃহীত মনে
অনুভব করে কোনো মনিবের সংকীর্ণ বেতনে
ভৃত্যের শরীর তার- ভৃত্যের শরীরে তার মন
নারী আর নক্ষত্রের তবু মহাজন?

তুমি এলে সময়ের ঢের আয়ূ শেষ ক’রে তবে
এখনো প্রদীপ জ্বলে এরকম স্থির অনুভবে
তোমার শরীর আজো সুশ্রী নম্র-তবুও হ্রদয়
সেই স্নিগ্ধ শরীরের সতীনের মতো কাঁটা নয়?
দুরু দুরু হৃদয়ের বিস্ময়ে ব্যথায় একথা যদি ভাবি
তবু সে ব্যথার চেয়ে আরেক শক্তির বেশি দাবি
সেই স্বাদ তুমি- আমাদের চোখে এসেছিলে ব’লে
পৃথিবীকে ভালো ক’রে পাই আমি-এ পৃথিবী অন্তর্হিত হ’লে।

সত্যই সূর্যের আলো- তবুও সূর্যের চেয়ে সুখী
তোমার গভীরভাবে ভালো শরীরের মুখোমুখি
আমার শরীর-মন- ঈশ্বরেরা অনুরোধে কখনো সময়
গতি কি থামায় তার-লীন হলে অনুসৃত হয়?
তুমি তাকে থামায়েছ-সৃষ্টির অন্তিম হিতাহিত
ভুলে আজ কলকাতার শীতরাতে কবের অতীত
বহমান সময়কে অন্ধকার চোখঠার দিয়ে
নারীর শরীর নিয়ে রয়েছ দাঁড়িয়ে।
তোমার উরুর চাপে সময় পায়ের নিচে প’ড়ে
থেমে আছে ব’লে মৃত তারিখকে আবিষ্কার করে
ভালোবাসা বেঁচে উঠে, আহা, এক মুহুর্তের শেষে
তবুও কি ম’রে যাবে পুনরায় সময়ের গতি ভালোবেসে?
অতীত তো সুজাতার শিশু; নারি, মনীষীহৃদয়
সে শিশুকে বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত নয়।

হে সময় একদিন তোমার গহীন ব্যবহারে
যা হয়েছে মুছে গেছে, পুনরায় তাকে
ফিরিয়ে দেবার কোনো দাবি নিয়ে যদি
নারীর পায়ের চিহ্নে চ’লে গিয়ে তোমার সে অন্তিম অবধি
তোমাকে বিরক্ত করে কেউ
সব মৃত ক্লান্ত ব্যস্ত নক্ষত্রের চেয়েও অধিক
অধীরতা ক্ষমতায় ব্রক্ষ্মাণ্ড শিল্পের শেষ দিক
এই মহিলার মত নারীচোখে যদি কেউ খুঁজে ফেরে-তবে
সেই অর্থ আমাদের এই মুহুর্তের মতো হবে।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন