সোনালি সিংহের গল্প

62
0

আমাদের পরিজন নিজেদের চিনেছিলো না কি?
এই সব সংকল্পের পিছে ফিরে হেমন্তের বেলাবেলি দিন
নির্দোষ আমোদ সাঙ্গ ক’রে ফেলে চায়ের ভিতরে;
চায়ের অসংখ্য ক্যান্টিন।
আমাদের উত্তমর্ণদের কাছে প্রতিজ্ঞার শর্ত চেয়ে তবু
তাহাদের খুঁজে পাই ছিমছাম,- কনুয়ের ভরে
ব’সে আছে প্রদেশের দূর বিসারিত সব ক্ষমতার লোভে।
কোথায় প্রেমিক তুমি; দীপ্তির ভিতরে!
কোথাও সময় নেই আমাদের ঘড়ির আঁধারে।
আমাদের স্পর্শাতুর কন্যাদের মন
বিশৃঙ্খল শতাব্দীর সর্বনাশ হ’য়ে গেছে জেনে
সপ্রতিভ রূপসীর মতো বিচক্ষণ,
যে-কোনো রাজার কাজে উৎসাহিত নাগরের তরে;
যে-কোনো ত্বরান্বিত উৎসাহের তরে;
পৃথিবীর বারগৃহ ধ’রে তারা উঠে যেতে চায়।
নীরবতা আমাদের ঘরে।
আমাদের ক্ষেতে-ভূঁয়ে অবিরাম হতমান সোনা
ফ’লে আছে ব’লে মনে হয়;
আমাদের হৃদয়ের সাথে
সে-সব ধানের আন্তরিক পরিচয়
নেই; তবু এই সব ফসলের দেশে
সূর্য নিরন্তর হিরণ্ময়;
আমাদের শস্য তবু অবিকল পরের জিনিস
মিড্‌ল্‌ম্যানদের কাছে পর নয়।
তাহারা চেনায়ে দেয় আমাদের ঘিঞ্জি ভাঁড়ার,
আমাদের জরাজীর্ণ ডাক্তারের মুখ,
আমাদের উকিলের অনুপ্রাণনাকে,
আমাদের পড়পরতার সব পড়তি কৌতুক
তাহারা বেহাত ক’রে ফেলে সব।
রাজপথে থেকে-থেকে মূঢ় নিঃশব্দতা
বেড়ে ওঠে; অকারণে এর-ওর মৃত্যু হ’য়ে গেলে-
অনুভব ক’রে তবু বলবার মতো কোনো কথা
নেই। বিকেলে গা ঘেঁষে সব নিরুত্তেজ সরজমিনে ব’সে
বেহেড আত্মার মতো সূর্যাস্তের পানে
চেয়ে থেকে নিভে যায় এক পৃথিবীর
প্রক্ষিপ্ত রাত্রির লোকসানে।
তবুও ভোরের বেলা বার-বার ইতিহাসে সঞ্চারিত হ’য়ে
দেখেছে সময়, মৃত্যু, নরকের থেকে পাপীতাপীদের গালাগালি
সরায়ে মহান সিংহ আসে যায় অনুভাবনায় স্নিগ্ধ হ’য়ে,-
যদি না সূর্যাস্তের ফের হয়ে যায় সোনালি হেঁয়ালি।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন