সারা দিন ট্রাম-বাস

72
0

সারাদিন ট্রাম-বাস-ফেরিওলাদের ডাক- কুষ্ঠরোগী পথের উপর-
হাড়ভাঙা মহিষের গাড়িগুলো-বাজারের রুক্ষ শব্দ-বস্তির চিৎকার।
আমার হৃদয়ে যেই শঙ্খমালা কিশোরীটি বাঁধিতে আসিয়াছিল ঘর
তাহারে ফিরায়ে দেয় শহরের পথ থেকে পাড়াগাঁর কান্তারের পার-

কবে যে কান্তার ছেড়ে আসিয়াছি নির্বাসিত আমি রাজপুত্রের মতন,
কোথায় শিমের গন্ধ? শ্যামা পাখি? কিশোর গেল কি মরে বুকের ভেতর?
দুপুর ঘনায়ে ওঠে ভিজা মেঘে- চিল কাঁদে-কই বলো?
কই হীরামন?-
আমার হৃদয়ে যে গো শঙ্খমালা কিশোরীটি বাঁধিতে আসিয়াছিলো ঘর।

আমি যে সংসারে মন দিতে চাই, আমি যে বাঁধিতে চাই পৃথিবীর
মানুষের মতো
বাসা এক; আমি যে বন্দরে যাই, অন্নের উপায় করি-স্বামী হই
পিতা হই আমি;
আমি যে ভিড়ের গন্ধ গায়ে মাখি দিনরাত; আঁধারে ঘুমাই, দিনে
রৌদ্রে ইতস্তত
ঘুরে ফিরি; সংসারের কাজ কথা হাটের ভিতরে আমি অলক্ষ্যে যে
পড়িতেছি নামি-
এইসব ছেড়ে দিয়ে, হে হৃদয়, চলে যাও অঘ্রাণের পাড়াগাঁর ম্লান
তেপান্তরে,
সেখানে বটের বুকে দাঁড়কাক বাঁধে বাসা-রাঙা পশমের মতো
ফলগুলো ঝরে
শুকনো পাতার ‘পরে; সেখানে সন্ধ্যার বক শঙ্খের মতন শাদা
পাখনা ভাসায়
কামরাঙা-রক্তমেঘে-তিনশো বছর ধরে কোন্‌ অভিমানী মঠ
দেখা যায়-
খড়কুটা মুখে নিয়ে শালিখ উড়িয়া যায় কান্তারের ঘাস থেকে
প্রান্তরের ঘাসে,
এক তারা ফুটিতেই রূপসী প্রেতিনী সেই শঙ্খমালা দেখা দেয়
মাঠের বাতাসে। …


যেদিন আমি পৃথিবীর থেকে চলে যাব- হে শঙ্খমালা-
অপরিসীম নক্ষত্র তুমি বিছিয়ে রেখো আকাশে,
আকাশের অন্ধকার সমতলতা ঘিরে যুগান্তের লুপ্ত মানবীদের মতো
কয়েকটি নির্জন নক্ষত্র-
এর চেয়ে গভীর জিনিস কী আর থাকতে পারে
কী আর থাকতে পারে শঙ্খমালা-

আর আমার বিছানা করে দিয়ো সমতল দেশের শিয়রে
সবুজ ঘাসের ছবির ভিতর
ধানসিড়ি নদীর জলের গন্ধের কাছে
এই বাংলায়।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন