রেনকোট কাঁধে রেখে

117
0

রেনকোট কাঁধে রেখে শহরের রাস্তায় কত বার নেমেছি যে রাতে
কত যে গভীর রাত হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে
কেবল গিয়েছি চলে পিছল পথের থেকে আরো দূর অন্ধকার পথে
গলির ঘুঁজির ফাঁকে- ডাস্টবিন ইঁদুরের বিড়ালের আড়ষ্ট জগতে
কত যে গভীর রাতে রাতে
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু গ্যাসপোস্টদের সাথে-

হাইড্রেন্ট খুলে গিয়ে কুষ্ঠরোগী ধুয়েছে নীরবে ক্লেদ শরীরে তাহার
গ্যাসের আলোর দিকে চেয়ে আছে ঘোলা চোখ হিম কাঠ মৃতবৎসার
নেড়িকুকুরের ক্ষুধা পথ থেকে পথে মিটে যায় ট্যাক্সির নিচে
চেয়ে দেখি চূর্ণ তার দাঁত মুখ নিঃসহায় নক্ষত্রের দিকে আছে খিঁচে
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-

অবসন্ন ট্রাম বাস্‌ কলের পৃথিবী সব তখন গিয়েছে চলে ঘরে
তবুও মানুষ- সে যে কল নয়- পথ থেকে আরো দূর পথের ভিতরে
একা একা চলে যায়- যতদূর স্তব্ধ এই শহরের গ্যাসপোস্ট জ্বলে
কী যেন কিসের তরে হাঁটিয়াছি- হেঁটে হেঁটে একদিন ক্লান্ত হবো বলে
কত যে গভীর রাতে রাতে
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-

তবুও কোনো ক্লান্তি নাই- কী যে চাই গাঢরাতে মিনোটায় মিনারের পাশে
একেলা দাঁড়াই গিয়ে- নক্ষত্রেরা মুখোমুখি দাঁড়ায়েছে কঠিন আকাশে
বাতাসে ভাসিয়া আসে ধুলো খড় হিম হাওয়া একফোঁটা – আধফোঁটা জল
আমারে কে ডাকে যেন- কেউ নাই; হাওয়া শুধু কথা কয় কেমন বিহবল-
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-

চুরুট জ্বালাই চুপে; এখন কত যে রাত- আকাশ ভরেছে ছেঁড়া মেঘে
সারা রাত জলে জলে ভিজে ফিরি…… প্রণয়িনী ডাহুকীর মতন আবেগে
কার সাথে প্রেম তবু? কে বা সেই? কারে আমি ভালোবাসি নক্ষত্রের তলে!
বেবিলনে তারে আমি দেখিয়াছি- আজো আর লাগি আমি ভিজি জলে জলে-
কত যে গভীর রাতে রাতে
হেঁটেছি হেঁটেছি শুধু স্তব্ধ গ্যাসপোস্টদের সাথে-

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন