কোহিনূর

95
0

তোমারে ঘেরিয়া জাগে কত স্বপ্ন–স্মৃতির শ্মশান,
ভুলুণ্ঠিত লুব্ধ অভিযান;
সাম্রাজ্যের অশ্রু, রক্ত, সমাধি, পতন
হে হীরক, একে একে করেছ চুম্বন!
স্পর্শে তব অনাদি অতীত যেন নিরন্তর মর্মে ওঠে ধ্বনি!
মাধবের বক্ষে তুমি ছিলে কি গো স্যমন্তক মণি!
শ্ৰীহরির বনমালা চুমি
দিব্য গন্ধে অকলঙ্ক অঙ্ক তব ভরেছিলে তুমি
ওগো কোহিনূর।
হৃদে তব আজও বুঝি গাঁথা আছে গোপনীয় বাঁশরির সুর,
যুগান্তের গাঢ় নীল পুলিনের ভাষা,
বাসনা পিপাসা!
অরুণ ময়ুখ স্পর্শে নিশান্তের স্বপ্ন যাও ভুলি!
নব নবীনের লাগি যুগে যুগে উঠিছ মুকুলি
অভিনব রূপে!
নির্মম কালের অগ্নি-অঙ্গারের স্তুপে
দেহ তব যায় না দহিয়া
হে অটুট বজ্ৰমণি, কোটি কোটি প্রেমিকের বরণীয়া প্রিয়া।
গিয়েছিলে কবে তুমি পাঠানের অন্তঃপুরে পশি
সুলতান-প্ৰেয়সী!
হারেমের অন্ধকারে লক্ষ বাদী বেগমের মাঝে
স্থিরপ্ৰভা দামিনীর সাজে!
মৌন শিখা স্পর্শে তব করেছিলে ইন্দুনিভা কত শত রূপসীর বদন পাণ্ডুর
ওগো কোহিনূর।
ম্লান করি দিলে কত আননের সুশ্ৰী শশীলেখা,
বিচ্ছুরিলে জ্যোতিঃপাত মদগৰ্ব মোগলের প্রমোদসভাতে;
বিভ্রমের লীলাকক্ষে–বিলাসের খুশরোজ রাতে
শাহী বেগমের আঁখি হয়েছিল অশ্রু ছলছল
তোমার সম্পদস্বপ্নে—অলখিতে ছায়াচ্ছন্ন হয়েছিল
উল্লাসের সে মোতিমহল।
নিশীথলাঞ্ছন বিভা জ্বলিয়া উঠিল কবে কাম্য মণি-ময়ূরের চোখে—
কত দীর্ঘ শতাব্দীর অশ্রু দৈন্য শোকে
করে গেল জয়শ্ৰীসম্পাত
উদয়-অরুণসম, তারপর কবে অকস্মাৎ
অস্তগত সাম্রাজ্যের কবর ভাঙিয়া
অভিসারে চলে গেল, প্ৰিয়া-উদাসিয়া
দূর সিন্ধুপারে
ঐশ্বৰ্য-তোরণ-তটে তুঙ্গ সিংহদ্বারে!
নব অভিনন্দনের উন্মেষের দেশে,
আমাদের সৌভাগ্যের শোক রক্ত স্তব্ধ বেলাশেষে!

বাসে না সে অশ্রুহিম কুহেলিরে ভালো
মৃত্যুর পিঙ্গল ছায়া প্রেতপুর কালো
আলেয়ার আলো
করে নাকো বিমুগ্ধ তাহারে!
পিরামিডসম সুপ্ত সমাধির দ্বারে
দাঁড়ায় না নিস্পলক প্রহরীর বেশে!
–চেয়ে থাকে,
কবে কোন প্ৰেমাস্পদ এসে
অঙ্কে তার এঁকে দেয় যৌবনের অরুণ-চুম্বন
নিমেষের আঁখিপাতে কেড়ে লয় মন।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন