কয়েকটি লাইন

156
0

কেউ যাহা জানে নাই কোনো এক বাণী –
আমি বহে আনি;
একদিন শুনেছ যে সুর –
ফুরায়েছে পুরনো তা — কোনো এক নতুন কিছুর
আছে প্রয়োজন,
তাই আমি আসিয়াছি, আমার মতন
আর নাই কেউ!
সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে আমি এক ঢেউ
আজিকার: শেষ মুহুর্তের
আমি এক — সকলের পায়ের শব্দের
সুর গেছে অন্ধকারে থেমে;
তারপর আসিয়াছি নেমে
আমি;
আমার পায়ের শব্দ শোনো –
নতুন এ, আর সব হারানো — পুরনো।
উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,
পড়ি নাকো দুর্দশার গান,
কে কবির প্রাণ
উৎসাহে উঠেছে শুধু ভরে –
সেই কবি — সেও যাবে সরে;
যে কবি পেয়েছে শুধু যন্ত্রণার বিষ
শুধু জেনেছে বিষাদ,
মাটির আর রক্তের কর্কশ স্বাদ,
যে বুঝেছে, প্রলাপের ঘোরে
যে বকেছে — সেও যাবে সরে;
একে একে সবই
ডুবে যাবে — উৎসবের কবি,
তবু বলিতে কি পারো
যাতনা পাবে না কেউ আরো?
যেইদিন তুমি যাবে চ’লে
পৃথিবী গাবে কি গান তোমার বইয়ের পাতা খুলে?
কিংবা যদি গায় — পৃথিবী যাবে কি তবু ভুলে
একদিন যেই ব্যথা ছিল সত্য তার?
আনন্দের আবর্তনে আজিকে আবার
সেদিনের পুরানো আঘাত
ভুলিবে সে? ব্যথা যারা সয়ে গেছে রাত্রি — দিন
তাহাদের আর্ত ডান হাত
ঘুম ভেঙে জানাবে নিষেধ;
সব ক্লেশ আনন্দের ভেদ
ভুল মনে হবে;
সৃষ্টির বুকের পরে ব্যথা লেগে রবে,
শয়তানের সুন্দর কপালে
পাপের ছাপের মতো সেইদিনও! –
মাঝরাতে মোম যারা জ্বালে,
রোগা পায়ে করে পায়চারি,
দেয়ালে যাদের ছায়া পড়ে সারি সারি
সৃষ্টির দেয়ালে –
আহ্লাদ কি পায় নাই তারা কোনোকালে?
যেই উড়ো উৎসাহের উৎসবের রব
ভেসে আসে — তাই শুনে জাগে নি উৎসব?
তবে কেন বিহ্বলের গান
গায় তারা! — বলে কেন, আমাদের প্রাণ
পথের আহত
মাছিদের মতো!

উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,
পড়ি নাকো ব্যর্থতার গান;
শুনি শুধু সৃষ্টির আহ্বান –
তাই আসি,
নানা কাজ তার
আমরা মিটায়ে যাই –
জাগিবার কাল আছে — দরকার আছে ঘুমাবার;
এই সচ্ছলতা
আমাদের;আকাশ কহিছে কোন্‌ কথা
নক্ষত্রের কানে?
আনন্দের? দুর্দশার? পড়ি নাকো। সৃষ্টির আহ্বানে
আসিয়াছি।
সময়সিন্ধুর মতো:
তুমিও আমার মতো সমুদ্রের পানে, জানি, রয়েছ তাকায়ে,
ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে গায়ে
ঘুম ভেঙে যায় বার বার
তোমার — আমার!
জানি না তো কোন্‌ কথা কও তুমি ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে,
ওপারের থেকে;
সমুদ্রের কানে
কোন্‌ কথা কই আমি এই পারে — সে কি কিছু জানে?
আমিও তোমার মতো রাতের সিন্ধুর দিকে রয়েছি তাকায়ে,
ঢেউয়ের হোঁচট লাগে গায়ে
ঘুম ভেঙে যায় বার বার
তোমার আমার!

কোথাও রয়েছ, জানি, তোমারে তবুও আমি ফেলেছি হারায়ে;
পথ চলি — ঢেউ ভেজে পায়ে;
রাতের বাতাস ভেসে আসে,
আকাশে আকাশে
নক্ষত্রের পরে
এই হাওয়া যেন হা হা করে!
হু হু করে ওঠে অন্ধকার!
কোন্‌ রাত্রি — আঁধারের পার
আজ সে খুঁজিছে!
কত রাত ঝরে গেছে — নিচে — তারও নিচে
কোন্‌ রাত — কোন্‌ অন্ধকার
একবার এসেছিল — আসিবে না আর।
তুমি এই রাতের বাতাস,
বাতাসের সিন্ধু — ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর!
অন্ধকার — নিঃসাড়তার
মাঝখানে
তুমি আনো প্রাণে
সমুদ্রের ভাষা
রুধিবে পিপাসা
যেতেছে জাগায়ে
ছেঁড়া দেহে — ব্যথিত মনের ঘায়ে
ঝরিতেছ জলের মতন –
রাতের বাতাস তুমি — বাতাসে সিন্ধু — ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর!

গান গায়, যেখানে সাগর তার জলের উল্লাসে,
সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে,
যেখানে সমস্ত রাত ভ’রে,
নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে
যেই খানে,
পৃথিবীর কানে
শস্য গায় গান,
সোনার মতন ধান
ফ’লে ওঠে যেইখানে –
একদিন — হয়তো — কে জানে
তুমি আর আমি
ঠান্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপে থামি
সেইখানে বর পড়ে!
যেখানে সমস্ত রাত্রি রক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে,
সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে,
গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে।

ঘুমাতে চাও কি তুমি?
অন্ধকারে ঘুমাতে কি চাই? –
ঢেউয়ের গানের শব্দ
সেখানে ফেনার গন্ধ নাই?
কেহ নাই — আঙুলের হাতের পরশ
সেইখানে নাই আর –
রূপ যেই স্বপ্ন আনে, স্বপ্নে বুকে জাগায় যে রস
সেইখানে নাই তাহা কিছু;
ঢেউয়ের গানের শব্দ
যেখানে ফেনার গন্ধ নাই –
ঘুমাতে চাও কি তুমি?
সেই অন্ধকারে আমি ঘুমাতে কি চাই!
তোমারে পাব কি আমি কোনোদিন? — নক্ষত্রের তলে
অনেক চলার পথ — সমুদ্রের জলে
গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর — বাজে –
ফুরাবে এ — সব, তবু…. তুমি যেই কাজে
ব্যস্ত আজ — ফুরাবে না জানি;
একদিন তবু তুমি তোমার আঁচলকানি
টেনে লবে; যেটুকু করার ছিল সেইদিন হয়ে গেছে শেষ,
আমার এ সমুদ্রের দেশ
হয়তো হয়েছে স্তব্ধ সেইদিন, — আমার এ নক্ষেত্রের রাত
হয়তো সরিয়া গেছে — তবু তুমি আসিবে হঠাৎ
গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর সমুদ্রের জলে,
অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে!

আমার নিকট থেকে
তোমারে নিয়েছে কেটে কখন সময়!
চাঁদ জেগে রয়
তারা ভরা আকাশের তলে,
জীবন সবুজ হয়ে ফলে,
শিশিরের শব্দে গান গায়
অন্ধকার, আবেগ জানায়
রাতের বাতাস!
মাটি ধুলো কাজ করে — মাঠে মাঠে ঘাস
নিবিড় — গভীর হয়ে ফলে!
তারা ভরা আকাশের তলে
চাঁদ তার আকাঙ্খার স্থল খুঁজে লয় –
আমার নিকট থেকে তোমারে নিয়েছে কেটে যদিও সময়।
একদিন দিয়েছিলে যেই ভালোবাসা,
ভুলে গেছ আজ তার ভাষা!
জানি আমি, তাই
আমিও ভুলিয়া যেতে চাই
একদিন পেয়েছি যে ভালোবাসা
তার স্মৃতি আর তার ভাষা;
পৃথিবীতে যত ক্লান্তি আছে,
একবার কাছে এসে আসিতে চায় না আর কাছে
যে — মুহুর্তে;
একবার হয়ে গেছে, তাই যাহা গিয়েছে ফুরায়ে
একবার হেঁটেছে যে, তাই যার পায়ে
চলিবার শক্তি আর নাই;
সব চেয়ে শীত, তৃপ্ত তাই।
কেন আমি গান গাই?
কেন এই ভাষা
বলি আমি! এমন পিপাসা
বার বার কেন জাগে!
পড়ে আছে যতটা সময়
এমনি তো হয়।

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন