অনেক মৃত বিপ্লবী স্মরণে

69
0

তারা সব মৃত ।
ইতিহাসে তবুও তাদের
কেবলি বাঁচার প্রয়োজন ব’লে
তাদের উত্তর অধিকার
কোনো কোনো মানবের হাতে আসে।
তারা ম’রে গেছে।
সবারই জীবনে আলো প্রয়োজন জেনে
সকলের জন্যে স্পষ্ট পরিমিত সূর্য পেতে গিয়ে
তবুও বিলোল অন্ধকারে-
তারা আজ পৃথিবীর নিয়মে নীরব।
এই অই বাক্তির জীবনে
সুসময় শুভ অর্থ পরিচ্ছন্নতার
প্রয়োজন র’য়ে গেছে জেনে নিয়ে তারা,
তবুও, ব্যক্তির চেয়ে ঢের বেশি গহন স্বভাবে উৎসারিত
জীবন-বিসারী ক্ষুব্ধ জনতাসমুদ্র দেখেছিল।
সেইখানে এক দিন মানুষের কাহিনী জন্মেছে;
বেড়ে গেছে;
কাহিনীর মৃত্যু হয় নাই;
কাহিনী ক্রমেই ইতিহাস।
জীবনধারণে- জানি- তবু-
জীবনকে, ভালো ক’রে অর্থময় ক’রে নিতে গিয়ে
ইতিহাস কেবলি আয়ত হয়ে আলো পেতে চায়।
নিজেদের আব্‌ছা ব্যক্তির মত মনে ক’রে তারা,
ইতিহাস স্পষ্ট ক’রে দিতে গিয়ে তবু
আজ এই শতকের শূণ্য হাতে শূন্যতার চেয়ে বেশি দান
দিয়েছিল হয়ত বা।
দেয় নি কি?
আজ এই হেমন্তের অন্ধকার রাতে
আমরা বিহ্বল ব্যক্তি,- তুমি- আমি- আরো ঢের লোক;
মানুষ-সমুদ্রে ঠেকে অন্ধকার বিম্বের মতন
তবুও সবার আগে নিজের আকাশ
নিজের সাহস স্বপ্ন মকরকেতন
আপনার মননশীলতা
গণনার প্রিয় জিনিসের মত মনে ভেবে নিয়ে
অন্য সকলের কথা ভুলে যাই।

সকলের জীবনের শুভ উদযাপনের চেষ্টায়
সূর্যের সুনাম আরো বড় ক’রে দিতে গিয়ে তারা
নিজেদের বিষণ্ণ সূর্যের কথা ভুলে গিয়েছিল।
মানবের কথা বিরচিত হয়ে চলে-
সেই সব দূর আতুর ভঙ্গুর সুমেরীয় দিন থেকে আজ
জেনিভায়,- মস্কৌ-ইংলান্ড্- আত্‌লান্তিক চার্টারে,
ইউ-এন্-ওয়ের ক্লান্ত প্রৌঢ়তায়- সতর্কতায়,
চীন- ভারতের- সব শীত পৃথিবীর
নিরাশ্রয় মানবের আত্মার ধিক্কারে- অন্তর্দানে।
হেমন্তের রাত আজ ক্ষুব্ধতায়- জনতায়- নর্দমায়-ক্লেদে
লোভাতুর ক্রূর রাষ্ট্রসমাজের রতির নৈরাজ্যে
অসম্ভব অন্ধ মৃত্যুতে
ফুরোনো ধানের ক্ষেতে তবু
মৃত পঙ্গপালদের ভিড়ে
নরকের নিরাশার প্রয়োজন র’য়ে গেছে জেনে, তবু বলে :
‘গভীর- গভীরতর তবুও জীবন-
নিজেদের দীনাত্মা ব্যক্তির মত মনে ক’রে ওরা
সকলের জন্যে সময়ের
সুন্দর, সীমিত আলো সঞ্চারিত ক’রে দিতে গিয়ে
প্রাণ দিয়েছিল ।
জীবনধারণে, তবু জীবনের আরো বর্ণনীয়
ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে আরো সুস্থ- আরো প্রিয়তর
ধারণায় ইতিহাস:- ইঙ্গিতের আরো স্পষ্টতায়;
তবে তা’ উজ্জ্বল হ’লে জীবন তবুও
নিরালোক হয়ে রবে কত দিন?
কত দিন হতে পারে!’

জীবনানন্দ দাশ
লিখেছেন

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মেলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

জীবনানন্দ দাশের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ঝরাপালক (১৯২৭)
* ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬)
* বনলতা সেন (১৯৪২)
* গীতি কবিতার গল্প (১৯৪৮)
* রূপসী বাংলা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার কবিতায় রয়েছে স্বতন্ত্র কবিতার ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলা কাব্যে আধুনিকতার নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে।

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে:

* কালবেলায় (১৯৫১)
* জীবিত ও মৃত (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্পে প্রকৃতির সৌন্দর্য, প্রেম, বিরহ, জীবনের অনিশ্চয়তা, মৃত্যু, একাকীত্ব, উদ্বেগ, আশা, নিরাশা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, ইত্যাদি নানামুখী বিষয়ের চিত্রায়ণ দেখা যায়। তার ছোটগল্পে রয়েছে স্বতন্ত্র গল্পের ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে:

* কবিতার কথা (১৯৪২)
* সাহিত্য কথা (১৯৫২)

জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধে সাহিত্যের স্বরূপ, কবিতার বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ, অলংকার, ইত্যাদি বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। তার সাহিত্যকর্ম বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন। তার সাহিত্যকর্ম পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের গুরুত্ব নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি বাংলা কাব্যে নৈরাজ্যের স্রষ্টা। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন।

মন্তব্য করুন