অন্ধ বধূ

132
0

পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!
আস্তে একটু চলনা ঠাকুর-ঝি —
ওমা, এ যে ঝরা-বকুল ! নয়?
তাইত বলি, বদোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল — মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল — কতই মনে হয় ।
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরি ভাই —
আমের গায়ে বরণ দেখা যায় ?
—অনেক দেরি? কেমন করে’ হবে !
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিন হাওয়া —বন্ধ কবে ভাই ;
দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে —
শেওলা-পিছল — এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয়না কিন্তু তায় —
অন্ধ চোখের দ্বন্ধ চুকে’ যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্ ,
অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা —দাদা তো তার আগে?
এই আষাড়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ি আসার পথ খুঁজে’ না পাবে —
দেখবি তখন —প্রবাস কেমন লাগে ?
—কী বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল ?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল !
কত লোকেই যায় তো পরবাসে —
কাল-বোশেখে কে না বাড়ি আসে ?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ !
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভায়ের সবই স্বতন্তর —
ফিরে’ আসার নাই কোন উদ্দেশ !
—ঐ যে হথায় ঘরের কাঁটা আছে —
ফিরে’ আসতে হবে তো তার কাছে !
এই খানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল-ভারি — ফসকে যদি যাই —
এ অক্ষমার রক্ষা কী আর আছে !
আসুন ফিরে’ — অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা —
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্ম শোধের বিদায় নিয়ে ফিরে’ —
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে।
‘চোখ গেল ঐই চেঁচিয়ে হ’ল সারা।
আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা —
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ !
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার — ছাই!
কাঁদতে গেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
‌‌‍‍‍‌’চোখ’ গেল– তার ভরসা তবু আছে —
চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে !
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি —
সেই তো ফিরে’ যাব আবার বাড়ি,
একলা-থাকা-সেই তো গৃহকোণ —
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে —
দরদ-ভরা দুখের আলাপন
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত !
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে —
বন্ধ চোখের অশ্রু রুধি পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চির-বিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে —
সকল বালাই বহি আপন মাথায় ! —
দেখিস তখন, কানার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয় না যেন তাঁর।
তারপরে – এই শেওলা-দীঘির ধার —
সঙ্গে আসতে বলবনা’ক আর,
শেষের পথে কিসের বল’ ভয় —
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে —
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়।
শেওলা দীঘির শীতল অতল নীরে —
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে’!

যতীন্দ্রমোহন বাগচী
লিখেছেন

যতীন্দ্রমোহন বাগচী

যতীন্দ্রমোহন বাগচী ছিলেন একজন বাঙালি কবি, সম্পাদক, এবং সরকারি কর্মচারী। তিনি ১৮৭৮ সালের ২৭শে নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জমশেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস হুগলি জেলার বলাগড় গ্রামে।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী কলকাতার ডাফ কলেজ (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে বিএ পাস করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিচারপতি সারদাচরণ মিত্রের সচিব, নাটোরের মহারাজার সচিব, কলকাতা কর্পোরেশনের লাইসেন্স-ইন্সপেক্টর, এফ.এন গুপ্ত কোম্পানির ম্যানেজার প্রভৃতি পদে চাকরি করেন।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৯০৯ থেকে নিয়ে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত সাহিত্য পত্রিকা মানসী-র সম্পাদনায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯২১ থেকে নিয়ে বছরখানেক তিনি অপর এক সাহিত্য সাময়িকী যমুনা-র যুগ্ম সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি নজস্ব পত্রিকা পূর্বাচল চালু করেন এবং এর সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী একজন রোমান্টিক কবি ছিলেন। তার কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, এবং মানবতাবাদের বিষয়গুলি প্রাধান্য পেয়েছে। তার কবিতার ভাষা সুন্দর, ছন্দময়, এবং মর্মস্পর্শী।

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে "উষা", "সাধনা", "কল্যাণী", "আশা", "ভালোবাসা", এবং "বিজয়ী"। তার রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে "বিচারপতি সারদাচরণ মিত্র", "নাটোরের মহারাজা", "কলকাতা কর্পোরেশনের ইতিহাস", এবং "পূর্বভারতের ইতিহাস"।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী তার সাহিত্যকর্মের জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ১৯২৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের "জগত্তারিণী স্বর্ণপদক", এবং ১৯৩৭ সালে "রবীন্দ্র পুরস্কার" লাভ করেন।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৯৪৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক অমর কবি হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:

* প্রকৃতিপ্রেম: যতীন্দ্রমোহন বাগচী একজন প্রকৃতিপ্রেমী কবি ছিলেন। তার কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রহস্যের বর্ণনা অত্যন্ত সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক।
* প্রেম: যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতায় প্রেমের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কবিতায় প্রেমের নানা রূপ ও বৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে।
* মানবতাবাদ: যতীন্দ্রমোহন বাগচী ছিলেন একজন মানবতাবাদী কবি। তার কবিতায় মানবতার মহিমা ও মর্যাদার বর্ণনা রয়েছে।

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতায় তিনি বাংলার গ্রামীণ জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি সমাজের অসঙ্গতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। তার কবিতায় তিনি দেশপ্রেমের ভাবধারা প্রকাশ করেছেন।

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতার ভাষা সুন্দর, ছন্দময়, এবং মর্মস্পর্শী। তার কবিতায় তিনি বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।

মন্তব্য করুন