দিপক এবং একাত্তর

একটি ছোট গ্রাম দেবরাজ।গ্রামে বেশিরভাগই মুসলিম অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অনুসারী।তারমাঝেই ১৯৬৬ সালে বসত করতে চলে আসে দিপক আর তার স্ত্রী মধু।তারা ছিলো হিন্দু ধর্মের অনুসারী। তাদের আগের গ্রাম ছাড়ার কারণ সেখানে প্রায় প্রায় বন্যা হতো তাই চলে এসেছে।এখন ১৯৭০ সাল।
তাদের সংসার এখন ভালোই চলে।তাদের অর্থও হয়ে গেছে মোটামুটি ভালো।দিপক কৃষিকাজ করে আর মধু দর্জি কাজ করে বাড়িতে।তাদের ১ ছেলে আর একটি মেয়ে আছে।ছেলের নাম অপূর্ব তার বয়স ১২ বছর, মেয়ের নাম দোলা তার বয়স মাত্র ১০ বছর। দিপক আর মধু দুইজনেই খুশি কারণ তাদের সংসার জুড়ে দুই টি উজ্জ্বল নক্ষত্র সারা বাড়ি আলোকিত করে রাখে সারাক্ষন।অপূর্ব আর দোলাও খুব খুশি। দু’জনে খেলাধুলা করে কাটিয়ে দেয়, আর প্রতিদিন শিখে নতুন কিছু।তার বাবা মা দুজনেই সব প্রশ্নের উত্তর দেয় খুব খুশিতে। অপূর্ব আর দোলা দুজনেই এখন কচি,ব্রেইনটাও পরিষ্কার তাই সবকিছুই খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলে।তারা রোজ বিদ্যালয়ে যায় কিন্তু পড়ালেখা তত ভালো নয়।কারণ দেশের অবস্থা বেশি ভালো না।পশ্চিম পাকিস্তানিরা সুবিধা বঞ্চিত করে রেখেছে।

দেখতে দেখতে বছর কেটে গেলো।শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর সারাদেশ তখন উত্তাল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা হামলা করেছে দেশে, মেরে ফেলছে লক্ষ লক্ষ মানুষ।অপূর্ব আর দোলা স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে।বাড়িতেই থাকে ওরা।কিছুদিন যাবত দিপকের শরির টা বেশি ভালো নয় জ্বর এসেছে, মাঠেও যেতে পারছেনা। কি করবে ফসল হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে, অনেকদিন যাবত ধানক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করা হয়নি।আজ বুধবার দিপক জ্বর শরীর নিয়েই মাঠে যাচ্ছে।মধু অনেক বারণ করার পরও দিপক যাচ্ছে।দিপক মধুকে বললো “মাঠে যেতে না পারলে ফসল নষ্ট হয়ে যাবে,আর এখন দেশের অবস্থা বেশি ভালো নয় খাবো কি আমরা?”এই বলে দিপক চলে গেলো মাঠে।মধু বাচ্চাদের খাবার খাওয়ালো। তারপর মেশিনে গিয়ে বসলো জামা তৈরি করতে।একটু পরেই দিপক হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লো।মধু তাড়াতাড়ি পাশে এসে বসলো।অপূর্ব দোলাও দৌড়ে এসে দিপক কে বললো “কি হয়েছে বাবা?”দিপক ওদের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মধুকে বললো “আমাকে একটু জল দাও ” মধু। তারাতারি ঘরে গিয়ে জল এনে দিলো ।তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে বড় একটা শ্বাস নিয়ে বললো “মধু আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে ! ”

এই কথা শুনে মধু ভয় পেয়ে গেলো।বললো মানে? অপূর্ব আর দোলা বললো “কোথায় যাবে বললে?”দিপক বলতে লাগলো -আমাদের গ্রামে হানাদার বাহিনী চলে এসেছে।তারা নিরীহ মানুষদের নির্যাতন করছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলছে। গ্রামে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়েছে।আমি তাদের সাথে যুদ্ধে যাবো। এই কথা শুনে অপূর্ব আর দোলা বলে, আমরাও তোমাদের সাথে যুদ্ধে যাবো বাবা।দিপক ওদের বুঝায় এবং মধুকে বলে ওদের দেখে রেখো।দিপক যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং এ যায়।মধু অশ্রুসিক্ত চোখে দিপক-কে বিদায় দিলো।সে বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের ভিতর চলে যায়।

দুদিন পর, দিপকের ট্রেনিং শেষ। সে এখন তার সর্বপুরি দিয়ে যুদ্ধ করছে।সে মাঝে মাঝে বাড়িতে যায়। তার পরিবারের খবর নিতে,দিপকের খুব মনে পরে তাদের, কিন্তু সে এখন একদিকেই লক্ষ রেখেছে।তাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের পরাজিত করে নিজের মাতৃভূমি কে রক্ষা করতে হবে।

একদিন মধু বারান্দায় বসে একটু ঝিমাচ্ছে। তখন সে একটা বিকট শব্দ শুনতে পেলো।দেখে আকাশ থেকে কালো ধোঁয়া ভেসে আসছে।আরো অনেক গুলির শব্দ সাথে মানুষের চিৎকার ভেসে আসছে। শব্দ শুনে অপূর্ব আর দোলা ঘর থেকে বের হয়ে মধু কে জিজ্ঞাসা করছে “মা কি হয়েছে ওরকম শব্দ কেনো?” মধু বলে কিছু না। সে পিছন বাড়ি যায়। গিয়ে দেখে হানাদার বাহিনী তাদের বাড়ির দিকে আসছে।মধু দৌড়ে বাড়ি আসে।অপূর্ব আর দোলাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। অপূর্ব তখন কথা বলতে যাবে, তখন মধু ওকে আটকে দেয় আর বলে চুপ থাকো।হানাদাররা কাউকে না দেখে ওদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মধু ও তার বাচ্চারা শুধু দেখলো কেমন করে তাদের সামনে তাদের বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
হানাদাররা চলে গেছে। মধু ও তার বাচ্চারা ঝোঁপ থেকে বের হয়ে দেখলো তাদের বাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।মধু ঘর বাড়ির ছাই হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।অপূর্ব আর দোলাও মধুকে কান্না করতে দেখে তারাও কান্না করতে লাগলো।

মধু ও তার বাচ্চারা এখন জঙ্গলের কাছে একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছে।অপূর্ব আর দোলা জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফল বা তরকারি কুড়িয়ে আনে, তা দিয়ে মধু রান্না করে। তাই খাওয়া দাওয়া করে মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খাবার নিয়ে যায়, আর খোঁজ খবর নিয়ে আসে।
একদিন অপূর্ব আর দোলা জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে খাবার খুঁজছে, তখন তারা হঠাৎ করে জঙ্গলের মাঝে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প খুজে পায়।
ওরা দেখতে পায় কিছু লোক মিলে কি নিয়ে যেনো আলোচনা করছে চুপিচুপি।অপূর্ব লুকিয়ে লুকিয়ে কাছে যায়। তারপর সে শুনতে পায় পাকিস্তানি বাহিনী আর রাজাকার সদস্যরা মিলে আলোচনা করছে, কাল নদীর ওপারে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করবে।কথা গুলো শুনে অপূর্ব দোলাকে নিয়ে মায়ের কাছে এসে সব খুলে বলে।তারপর মধু অপূর্ব আর দোলা কে নিয়ে নদীর ওপারে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছায়।তারপর মধু দিপক- কে সব খুলে বলে।দিপক মুক্তিবাহিনীর সবার কাছে সব কথা খুলে বলে এবং তারপরের দিন মুক্তিবাহিনীরা প্রস্তুত হয়।সঠিক সময় প্ল্যান করে মুক্তিবাহিনী।সুযোগ বুঝে আক্রমণ করে এবং মুক্তিবাহিনী এইবার সফল হয় তাদের অপারেশনে।

এরকম আরো নানা ভাবে মুক্তিবাহিনীদের সাহায্য করে মধু,অপূর্ব আর দোলা। মুক্তিযুদ্ধ চলতেই থাকে। একদিন মধু ও অপূর্ব দোলাকে গুহায় রেখে জঙ্গলে যায় খাবার খুঁজতে। মধু ও অপূর্ব ভালোই কিছু ফল নিয়ে গুহায় পৌঁছায়। পৌঁছে দেখে দোলাকে হানাদার বাহিনী গুলি করে মেরে রেখে গেছে। এটি দেখে মধু অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মাটিতে। অপূর্ব কান্না শুরু করে। কিছুক্ষণ পর মধুর জ্ঞান ফিরলে মধু অপূর্ব কে সাথে নিয়ে কান্না করতে করতে যায় দিপকের কাছে।দিপক শুনতে পেয়ে হুড়মুড় করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।অনেকক্ষণ পর মুক্তিবাহিনীর কিছু মানুষ মিলে দোলার লাশকে পুড়িয়ে দেয়। তারপর দিপক,মধু আর অপূর্ব ভেঙ্গে পরে কান্নায়।

কিছুক্ষণ পর মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক দিপক-কে শান্তনা দেয়, আর বলে “তোমার এ সময় ভেঙ্গে পড়লে চলবে না দিপক,তোমাকে শক্ত হতে হবে, যাদের কারণে তোমার মেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের থামাতে হবে, না হলে এরকম আরো অনেক বাবা মা তার ছেলেমেয়ে হারাবে।” এ কথা শুনে দিপক আবার যুদ্ধে মনযোগী হয়।

এভাবে আরো যুদ্ধ চলতে থাকে।মুক্তিবাহিনী একটার পর একটা সফল অপারেশন করতে থাকে। অপূর্ব আর মধু মুক্তিবাহিনীদের আরো অনেক তথ্য,খাবার ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করে।দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়।পাকিস্তানিরা পরাজয় মেনে নেয়।

দিপক আবার মধু আর অপূর্ব কে নিয়ে ছোট একটি ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করে। দেশে তখন খাবারের সংকট শুরু হয়ে গেছে।অনেক কষ্টে তারা সংসার চালাতে থাকে।মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় নাম নেওয়ার জন্য ওদের গ্রামে লোক আসে। অনেকেই নাম লেখায়, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নি তারাও নাম দেয়। এমনকি অনেক রাজাকারাও নাম দেয়।অনেকেই দিতে বলে কিন্তু দিপক দেয় না। কারণ জানতে চাইলে সে বলে “আমি যা করেছি আমার মাতৃভূমির জন্য করেছি এবং আমি এই দেশের নাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছি, এর জন্য আমি টাকা কেনো নিবো, দেশের সম্পদ কেনো নিবো?”

এখন অনেক বছর কেটে গেছে।প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধারা মারা যাচ্ছে। সবাই ভুলেই গেছে, দিপক একজন মুক্তিযোদ্ধা।কেউ জানলেও না জানার মতো ভান করে থাকে।

মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো দাম নেই।দিপক অর্থের দিক থেকে আর বেশি এগাতে পারে নি, কারণ যুদ্ধের সময় তার হাতে একটি গুলি লেগেছিলো।তাই সে ভালো করে কাজ করতে পারে না। সে এখন সমাজের কাছে এক অবহেলিত মানুষ। কারণ তাদের সমাজে মুসলিম ধর্মের অনুসারী।আর তার পরিবার হিন্দু ধর্মের অনুসারী। তাই তাকে অবহেলার চোখে দেখে সমাজ।
দিপক অপূর্ব কে ভালো করে পড়াতে পারে নি। কারণ তার স্কুলে সে একাই হিন্দু। অপূর্ব স্কুলে গেলেও ফিরে এসেছে,কারণ তার সহপাঠীরা তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে।দিপক যাও কষ্ট করে ছেলেকে পড়িয়েছে; কিন্তু এখন অপূর্ব পাচ্ছে না চাকরি। চাকরি নিতে গেলে লাগছে টাকা বা ঘুষ।কিন্তু দিপকের নেই টাকা, নেই সঞ্চয়। এরকম দৃশ্য দেখে দিপক তার গুলি লাগা হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে।আর ভাবে,যুদ্ধ করলাম, দেশ স্বাধীন হলো। দেশ স্বাধীন সত্যি কি হয়েছে?যে শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে,একটা অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে
,সুজলা সুফলা সোনার বাংলা গড়তে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এই কি তবে তার পরিণতি?
দিপক স্বপ্ন দেখেছিলো, এই দেশ হবে বাঙালির, জাত-ধর্মের উর্ব্ধে গিয়ে মিলমিশে বাস করবে সকলে।
ভাবতে ভাবতে তার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু টুপ করে পড়ে যায় মাটিতে। এই প্রশ্ন আজো তার মনে গেঁথে থাকে, আর মাঝেমধ্যে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠে-
সত্যিই কি হয়েছে দেশ স্বাধীন!?
সত্যিই কি হয়েছে দেশ স্বাধীন!?
সত্যিই কি হয়েছে দেশ স্বাধীন!?

দিপক এবং একাত্তর গল্পটি লিখেছিলাম ৮ম শ্রেণিতে থাকতে, পৃথিবী তখন কারাবন্দী। স্কুল বন্ধ ঘরে বসে থাকতে থাকতে লেখালেখির প্রতি প্রবল আগ্রহ কাজ করা শুরু করে। আর তখন থেকেই এই সমাজ, এই দেশ নিয়ে আমার ভাবনার শুরু। লিখে ফেললাম জীবনের প্রথম ছোটগল্প "দিপক এবং একাত্তর"।

1 মন্তব্য

মন্তব্য করুন