পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত

65
0

কাল রাতে ওরা আমার দেহ থেকে সিরিঞ্জ সিরিঞ্জ রক্ত তুলে নিয়েছে
আমাকে ওরা এক নিঃসঙ্গ অন্ধকার রাতের থমথমে নিস্তব্ধতার মধ্যে
বেঁধে রেখে বলেছে, ‘শাট আপ। কথা বললেই গুলি করব!’

তখনই সমস্ত পৃথিবী কাঁপিয়ে, সমস্ত চরাচর, বনভূমি কাঁপিয়ে
একটা ভয়ানক হাহাকার, মৃতদের কলরোল উড়ে এসে
আমার বুকের কাছে আছড়ে পড়েছে;
আমি কেঁপে উঠেছি।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আমার মায়ের মুখ
একটি নিঃসঙ্গ একাকী প্রদীপের নিচে বেদনায় নুয়ে থাকা
আমার জন্মদাত্রীর এলায়িত দেহের ভঙ্গিমা
চৌকাঠে এলোমেলো বাতাসের আঘাতে উদাসীন
আমার প্রিয়তমা, আমার সন্তান, আমার একমাত্র উত্তরাধিকার।
এইসব ভাবতে ভাবতে আমার রক্তের ভেতরে জেগে উঠেছে
এক পরাজিত সৈনিকের আহত, ক্ষতবিক্ষত, ক্লান্ত-দেহের
অস্বাভাবিক স্থবিরতা।

অথচ আমাকে থামলে চলবে না।
আমার সামনে কোটি কোটি মানুষের গগনবিদারী চিৎকার
আমার সামনে বিস্তৃত দিগন্তের নিচে অনাবিল সবুজ ধানের ক্ষেত
আমার সামনে পাকা ধানের মতো জীবনের
অবিরত সম্ভাবনার সোনালী ভাঁড়ার

আমার চোখে জল নেমে আসে।
আমি অনেকদিন অসম্ভব বৃষ্টির বিপুল জ্যোৎস্নার মধ্যে
শিশুর মতো খেলতে পারি নি
দুরন্ত বলের মতো সহস্র স্বপ্নের মধ্যে আমার নিবিড় প্রেম
অশ্ব হয়ে ছুটতে পারে নি কোনোদিকে
শুধু রক্তলাল এ জীবন বহতা নদীর মতো
প্রয়োজনে ছুটে গেছে দৃশ্য থেকে অদৃশ্যের দিকে।
বুকের ভিতরে জেগে উঠেছে শতাব্দীর নীল আর্তনাদ
জেগে উঠেছে শোষণের সহস্র কাহিনী

শৃঙ্খলিত জীবনের মর্মঘাতী অতীত যাতনা।
সাথে সাথে আমার শিথিল হাত
জড়াতে জড়াতে মুুষ্টিবদ্ধ ইস্পাতে পরিণত হয়েছে
আমার কম্পিত করতলে ঘেমে উঠেছে শতাব্দী-লাঞ্ছিত মানুষের
এক অসম্ভব উজ্জ্বল রাসায়নিক বাল্ব।
আমি এক্ষুণি আমার বাল্ব ছুঁড়ে দেব
আজ কোন পরিত্রাণ নেই
কাল রাতে তোমরা আমার দেহ থেকে সিরিঞ্জ সিরিঞ্জ রক্ত তুলে নিয়েছ
আজ তার প্রতিশোধ
এক ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে তোমাদের এক-একটা জীবনকে
আমি আমার স্বপ্নের আঘাতে ভেঙে টুকরো করে দেব।
আমার বুকের ভিতরে এক নিঃশংসয় নগরীর প্রজ্বলিত আভা
আমার বুকের ভিতরে একটি সমান পৃথিবীর সবুজ মানচিত্র
আমি এখন ইচ্ছে করলেই সমস্ত পৃথিবীকে
আমার হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারি,
শুধু প্রয়োজন প্রতিটি ঐতিহাসিক রক্তবিন্দুর কাছ থেকে
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস জেনে নেওয়া
আমি সেই রক্তবিন্দু থেকে সম্মুখের ইতিহাস অবধি
নিজের রক্তবিন্দুকে প্রবাহিত করে দিতে চাই
আমি একটি রক্তপাতহীন পৃথিবীর জন্যে
এই মুহূর্তে পৃথিবীর
মর্মঘাতী রক্তপাত করে যেতে চাই।

অসীম সাহা
লিখেছেন

অসীম সাহা

অসীম সাহা একজন বাংলাদেশী কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, এবং গীতিকার। তিনি ১৯৪৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস মাদারীপুর।

অসীম সাহা ১৯৬৪ সালে নেত্রকোণা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৬ সালে বরিশাল কলেজে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

অসীম সাহার লেখা প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে 'চাঁদ ও তারা' পত্রিকায়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'পূর্ব পৃথিবীর অস্থির জ্যোস্নায়' প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:

* ভালোবাসার কবিতা (১৯৭২)
* কালো পালকের নিচে (১৯৭৫)
* পুনরুদ্ধার (১৯৮৩)
* আগন্তুক (১৯৮৭)
* অনন্যা (১৯৯৩)
* গদ্যপদ্য (১৯৯৭)
* চিরদিন বাঙালি (২০০১)
* প্রেম ও বিরহ (২০০৫)

অসীম সাহা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক ছিলেন। তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেছেন।

অসীম সাহার সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৯ সালে একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

অসীম সাহার কবিতাগুলির মধ্যে প্রেম, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, মানবতাবাদ, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। তার কবিতাগুলির ভাষা ও ছন্দ অত্যন্ত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।

অসীম সাহার সাহিত্যকর্মের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক হল:

* তার কবিতাগুলির ভাষা ও ছন্দ অত্যন্ত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর।
* তার কবিতাগুলির মধ্যে প্রেম, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, মানবতাবাদ, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে।
* তার কবিতাগুলির মধ্যে নতুনত্ব ও সৃজনশীলতার ছোঁয়া রয়েছে।

অসীম সাহা বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

মন্তব্য করুন