১.
সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি ;
ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি ;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি ।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা ;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা ।
২.
হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;
প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তার চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।
এ কোন কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি
দরবিগলিত হয়ে ছলকে যায় রাত্রির বরণ,
মনে হয় ডাক দিলে সে-তিমিরে ঝাঁপ দিতে পারি
আচঁল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ।
বুকের ওপরে মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে
লিখতে কি দেবে নাম অনুজ্জ্বল উপাধিবিহীন?
শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেবো আদ্যাক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।
বাঙালী কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।
৩.
ঘুরিয়ে গলার বাঁক ওঠো বুনো হংসিনী আমার
পালক উদাম করে দাও উষ্ণ অঙ্গের আরাম,
নিসর্গ নমিত করে যায় দিন, পুলকের দ্বার
মুক্ত করে দেবে এই শব্দবিদ কোবিদের নাম।
কক্কর শব্দের শর আরণ্যক আত্মার আদেশ
আঠারোটি ডাক দেয় কান পেতে শোনো অষ্টাদশী,
আঙুলে লুলিত করো বন্ধবেণী, সাপিনী বিশেষ
সুনীল চাদরে এসো দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি।
ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দু’টি জলের আওয়াজ-
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়,
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ-লাক্ষারসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধায়।
৪.
এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবে কি, হে বন্য বালিকা
অভাবে অজগর জেনো তবে আমার টোটেম,
সতেজ খুনের মতো এঁকে দেবো হিঙ্গুলের টিকা
তোমার কপালে লাল, আর দীন-দরিদ্রের প্রেম।
সে-কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ
করে এই ঘরে তুলি ? আমার তো কপিলে বিশ্বাস,
প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ?
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।
৫.
আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?
গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,
কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল
নিয়ে এসো চন্দ্রলোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।
ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে?
প্রকৃতির ছদ্মবেশ যে-মন্ত্রেই খুলে দেন খনা
একই জাদু আছে জেনো কবিদের আত্মার ভিতরে।
নিসর্গের গ্রন্থ থেকে, আশৈশব শিখেছি এ-পড়া
প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল,
চিরস্থায়ী লোকালয় কোনো যুগে হয়নি তো গড়া
পারেনি ঈজিপ্ট, গ্রীস, সেরাসিন শিল্পীর আঙুল।
কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর
কষ্টকর তার চেয়ে নয় মেয়ে কবির অধর।
৬.
মাৎস্যন্যায়ে সায় নেই, আমি কৌম সমাজের লোক
সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে,
কোনো সামন্তের নামে কোনদিন রচিনি শোলোক
শোষকের খাড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের ‘পরে।
পূর্ব পুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস
মুখ ঢাকে আলাওল – রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।
এর চেয়ে ভলো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল?
আরশি নগরে খোঁজা বাস করে পড়শী যে জন
আমার মাথায় আজ চূড়ো করে বেঁধে দাও চুল
তুমি হও একতারা, আমি এক তরুণ লালন,
অবাঞ্ছিত ভক্তিরসে এ যাবৎ করেছি যে ভুল
সব শুদ্ধ করে নিয়ে তুলি নব্য কথার কূজন।
৭.
হারিয়ে কানের সোনা এ-বিপাকে কাঁদো কি কাতরা?
বাইরে দারুণ ঝড়ে নুয়ে পড়ে আনাজের ডাল,
তস্করের হাত থেকে জেয়র কি পাওয়া যায় ত্বরা-
সে কানেট পরে আছে হয়তো বা চোরের ছিনাল!
পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ।
ভদ্রতার আবরণে কতদিন রাখা যায় ঢেকে
যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার কাজ?
ভেঙো না হাতের চুড়ি, ভরে দেবো কানের ছেঁদুর
এখনো আমার ঘরে পাওয়া যাবে চন্দনের শলা,
ধ্রুপদের আলাপনে অকস্মাৎ ধরেছি খেউড়
ক্ষমা করো হে অবলা, ক্ষিপ্ত এই কোকিলের গলা।
তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর
না দেখার ভান করে কতকাল দেখবে, চঞ্চলা?
৮.
অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল
লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,
আর কোনদিন বলো দেখবো কি নতুন সকাল?
উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই।
বিষের আতপে নীল প্রাণাধার করে থরো থরো
আমারে উঠিয়ে নাও হে বেহুলা, শরীরে তোমার,
প্রবল বাহুতে বেঁধে এ-গতর ধরো, সতী ধরো,
তোমার ভাসানে শোবে দেবদ্রোহী ভাটির কুমার।
কুটিল কালের বিষে প্রাণ যদি শেষ হয়ে আসে,
কুন্তল এলিয়ে কন্যা শুরু করো রোদন পরম।
মৃত্যুর পিঞ্জর ভেঙে প্রাণপাখি ফিরুক তরাসে
জীবনের স্পর্ধা দেখে নত হোক প্রাণাহারী যম,
বসন বিদার করে নেচে ওঠো মরণের পাশে
নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।
৯.
যে বংশের ধারা বেয়ে শ্যাম শোভা ধরেছো, মানিনী
একদা তারাই জেনো গড়েছিলো পুণ্ড্রের নগর
মাটির আহার হয়ে গেছে সব, অথচ জনিনি
কাজল জাতির রক্ত পান করে বটের শিকড়।
আমারও নিবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে
পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টীকেরা পুরীর গৌরব,
রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব।
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন
করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর,
তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ?
ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বার বার:
বর্গীরা লুটছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ।
১০.
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়েছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ,
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ,
সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি
সুকণ্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ।
১১.
আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরূহ,
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝোলে আজ বিষণ্ণ বাদুড়
অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরূহ?
কী করে মানবো বলো, শ্রীজ্ঞানের জন্মভুমি এই
শীলভদ্র নিয়েছিলো নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস,
অতীতকে বাদ দিলে আজ তার কোনো কিছু নেই
বিদ্যালয়ে কেশে ওঠে গুটিকয় সিনানথ্রোপাস।
প্রস্তর যুগের এই সর্বশেষ উল্লাসের মাঝে
কোথায় পালাবে বলো, কোন ঝোপে লুকোবে বিহ্বলা?
স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও শরীরে বিরাজে
যখন আড়াল থেকে ছুটে আসে পাথরের ফলা,
আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।
১২.
নদীর সিকস্তী কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ
যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,
হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও
যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার।
অন্ধ আতঙ্কের রাতে ধরো ভদ্রে, আমার এ-হাত
তোমার শরীরে যদি থেকে থাকে শস্যের সুবাস,
খোরাকির শত্রু আনে যত হিংস্র লোভের আঘাত
আমরা ফিরাবো সেই খাদ্যলোভী রাহুর তরাস।
নদীর চরের প্রতি জলে-খাওয়া ডাঙার কিষাণ
যেমন প্রতিষ্ঠা করে বাজখাই অধিকার তার,
তোমার মস্তকে তেমনি তুলে আছি ন্যায়ের নিশান
দয়া ও দাবিতে দৃঢ় দীপ্তবর্ণ পতাকা আমার ;
ফাটানো বিদ্যুতে আজ দেখো চেয়ে কাঁপছে ঈশান
ঝড়ের কসম খেয়ে বলো নারী, বলো তুমি কার?
১৩.
লোবানের গন্ধে লাল চোখ দুটি খোলো রূপবতী
আমার নিঃশ্বাসে কাঁপে নকশাকাটা বস্ত্রের দুকূল?
শরমে আনত কবে হয়েছিল বনে কপোতী?
যেন বা কাঁপছো আজ ঝড়ে পাওয়া বেতসের মূল?
বাতাসে ভেঙেছে খোঁপা, মুখ তোলো হে দেখনহাসি
তোমার টিকলি হয়ে হৃদপিণ্ড নড়ে দুরু দুরু
মঙ্গলকুলোয় ধান্য ধরে আছে সারা গ্রামবাসী
উঠোনে বিন্নীর খই, বিছানায় আতর, অগুরু।
শুভ এই ধানদূর্বা শিরোধার্য করে মহিয়সী
আবরু আলগা করে বাঁধো ফের চুলের স্তবক,
চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী
সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক
বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।
১৪.
বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।
কথার খেলাপ করে আমি যদি জবান নাপাক
কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা,
এ-বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক
নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।
রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভঙে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল
এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লানৎ
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।